দ্বিতীয় পর্ব : দক্ষিণ, দক্ষিণ পূর্ব- এশিয়া এবং এশিয়ায় নির্বাচনী প্রতীক সংস্কৃতি

 

নির্বাচনী প্রতীক: ইতিহাস, প্রভাব ও ভবিষ্যৎ


দ্বিতীয় পর্ব : দক্ষিণ, দক্ষিণ পূর্ব- এশিয়া  এবং এশিয়ায় নির্বাচনী প্রতীক সংস্কৃতি 



 ভূমিকা: প্রতীকের গুরুত্ব


দক্ষিণ, দক্ষিণ -পূর্ব এবং এশিয়ার  রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী প্রতীক এক ধরনের সেতু হিসেবে কাজ করে। এটি ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যে মানসিক সংযোগ স্থাপন করে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে ভোটাররা প্রার্থীর নাম মনে রাখতে পারে না, সেখানে প্রতীক ভোটের প্রক্রিয়াকে সহজ ও কার্যকর করে।


প্রতীক কেবল ভোটদানের জন্য নয়, বরং এটি রাজনৈতিক সচেতনতা, গণমত গঠন, এবং সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ায়। এটি ভোটারদের মনে নির্দিষ্ট চিত্র সৃষ্টি করে, যার মাধ্যমে তারা সহজে ভোট দিতে পারে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত হয়।


প্রতীকের মাধ্যমে ভোটারের মানসিক সংযোগ স্থাপন করা যায়। ভোটার শুধু চিহ্ন দেখে প্রার্থীর নীতি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারে। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তখন যখন শিক্ষার হার কম, এবং রাজনৈতিক সচেতনতা সীমিত।





 বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতীকের ইতিহাস ও প্রভাব

বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতীকের ব্যবহার স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হয়েছে। প্রতীকের মাধ্যমে ভোটাররা  প্রার্থীর সঙ্গে  মানসিক সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। 

প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতীক:


আওয়ামী লীগ: নৌকা –  স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, জনগণের আশা ও সমৃদ্ধির প্রতীক।


বিএনপি: ধানের শীষ – গ্রামভিত্তিক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি , ঐক্য ও জনগণের সঙ্গে সংযোগ।


ছোট দল: মশাল , বাতি, বই,  হাতুড়ি, কাস্তে , সিংহ – প্রতিটি চিহ্ন গ্রামীণ ভোটারের জন্য পরিচিতি বহন করে।



গ্রামের ভোটাররা এই প্রতীক দেখে ভোট দেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি ছোট গ্রামের ভোটার যদি সাক্ষর না থাকে, তবে তারা নৌকা চিহ্ন দেখে জানে যে এটি আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এটি তাদের সিদ্ধান্তকে সহজ করে।


বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতীক শুধু রাজনৈতিক নয়; এটি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংযোগের মাধ্যম। গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতীকের মাধ্যমে জনগণ প্রার্থীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি এবং বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত হয়।





ভারতের নির্বাচনী প্রতীকের বৈচিত্র্য ও উদাহরণ


ভারতে নির্বাচনী প্রতীকের সংখ্যা বিশাল। প্রতিটি রাজনৈতিক দল নির্দিষ্ট প্রতীক ব্যবহার করে।


প্রধান উদাহরণ:


কংগ্রেস: হাত – ঐতিহ্য, গণসংযোগ ও জনআস্থা।


ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP): 



ভারতের জাতীয় ফুল, পদ্ম 

পদ্মফুল – শক্তি, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও আশা।


আঞ্চলিক দল: হাতি, ঘড়ি, সিংহ – স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংযোগ।



ভারতে গ্রামীণ ভোটারের কাছে প্রতীকের গুরুত্ব অপরিসীম। ভোটাররা প্রতীক দেখে প্রার্থীর নীতি ও দলকে সহজে সনাক্ত করতে পারেন। শহরে শিক্ষিত ভোটাররা প্রার্থীর নাম মনে রাখতে পারলেও, গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতীকের মনস্তাত্ত্বিক  ও সাংস্কৃতিক প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী।


উদাহরণ: ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলে ভোটাররা কেবল প্রতীকের মাধ্যমে ভোটার কার্ডে প্রার্থী শনাক্ত করেছিলেন। এটি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে দ্রুত ও স্বচ্ছ করেছে।





 পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা: নির্বাচনী প্রতীকের ব্যবহার


পাকিস্তান: 

ভোটাররা প্রতীকের মাধ্যমে প্রার্থীর সঙ্গে পরিচিত হয়। প্রধান প্রতীকগুলির মধ্যে ‘মাস্ক’, ‘ফুল’ এবং ‘হাতি’ উল্লেখযোগ্য।


নেপাল: 

গ্রামীণ ভোটারদের জন্য নির্দিষ্ট প্রতীক ব্যবহার অপরিহার্য।


শ্রীলঙ্কা:

 নির্বাচনী প্রতীক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিহ্নের সঙ্গে যুক্ত।



এই দেশগুলিতে প্রতীকের মাধ্যমে ভোটাররা সহজে ভোট দিতে পারে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় এবং রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে ওঠে।





 সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব




বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে  দলীয় প্রতীক দেখে  ভোটারদের ভোট প্রয়োগ 



নির্বাচনী প্রতীকের সামাজিক প্রভাব অপরিসীম।


গ্রামীণ সমাজে এটি ভোটারের মানসিক সংযোগ স্থাপন করে।


প্রতীকের মাধ্যমে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।


এটি নির্বাচনী অংশগ্রহণ বাড়ায়।



সাংস্কৃতিক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ।


প্রতীকের মাধ্যমে স্থানীয় ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিফলিত হয়।


উদাহরণ: ভারতের গ্রামীণ অঞ্চলে পদ্মফুলের প্রতীক আশা, সমৃদ্ধি ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত।


বাংলাদেশের নৌকা প্রতীকের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ স্বাধীনতা লাভ,  গণতন্ত্রের আশা ও ভবিষ্যতের সাথে সংযুক্ত হয়।


তাছাড়া দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ  ন্যায় এবং ইনসাফের  বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। 




 গ্রাম বনাম শহর


গ্রাম:


ভোটার প্রার্থীর নাম মনে রাখতে পারেন না।


প্রতীকের মাধ্যমে প্রার্থী সনাক্ত করা অপরিহার্য।



শহর:


ভোটার প্রার্থীর নাম ও দলের পরিচিতি জানে।


প্রতীক মানসিক সংযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।



শহর ও গ্রামে প্রতীকের গ্রহণযোগ্যতা পার্থক্যপূর্ণ হলেও, মানসিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগের জন্য এটি এখনও অপরিহার্য।





 নির্বাচনী প্রচারণা ও গণসংস্কৃতিতে প্রতীকের ভূমিকা



১৯৯০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর গণসংযোগ 


প্রতীকের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা কার্যকর হয়।


পোস্টার, দেয়ালচিত্র, গানে গান  নির্বাচনী  প্রচারণা এবং মিছিলের মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হয়।


এটি রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জনমত গঠনে সাহায্য করে।



যেমন -- বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রচারণায় নৌকা,ধানের শীষ কিংবা দাড়িপাল্লা  প্রতীকের ব্যবহার  বেশ লক্ষণীয় । ভোটাররা চিহ্ন দেখে প্রার্থীর সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং ভোটে অংশগ্রহণ করে।





 প্রযুক্তি ও আধুনিক ব্যবস্থায় প্রতীকের ব্যবহার


ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (EVM) এবং ডিজিটাল ব্যালট ব্যবহারে প্রতীকের প্রয়োজন কিছুটা কমেছে।


তবে প্রতীকের  মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব এখনো গুরুত্বপূর্ণ।


যেমন - ভারতের কিছু রাজ্যে ইভিএম  ব্যবহার হলেও প্রতীক এখনও প্রার্থীর সনাক্তকরণ ও ভোটার সংযোগে ব্যবহৃত হয়।





 

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: উন্নত বনাম উন্নয়নশীল দেশ


উন্নয়নশীল দেশ:


ভোটারদের মধ্যে শিক্ষার সীমিত সুযোগ।


প্রতীকের মাধ্যমে সহজ সনাক্তকরণ।


নির্বাচনী অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।



উন্নত দেশ:


উচ্চ শিক্ষার হার, শক্তিশালী দলীয় কাঠামো।


প্রতীকের প্রয়োজন নেই।


তথ্যের সহজলভ্যতা এবং সচেতন ভোটার।



 দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার  কিছু দেশ  এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতীকের ব্যবহার উন্নয়নশীল দেশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অপরিহার্য।





উপসংহার


 দক্ষিণ, দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার নির্বাচনী প্রতীকের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি ভোটার ও প্রার্থীর মানসিক সংযোগ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব, এবং রাজনৈতিক সচেতনতার অঙ্গ। গ্রামীণ ভোটারদের জন্য প্রতীক অপরিহার্য, শহরের ভোটারদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগের প্রতীক।






Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প