দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন
"গণতন্ত্রের ধারা : পি আর পদ্ধতির বিশ্লেষণ "
[ দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরণ ]
![]() |
"রাজনীতি শুধু বুড়োদের কাজ নয়—তরুণের শক্তি পরিবর্তন করে দিতে পারে গণতন্ত্রের গতিপথ।” |
পাঠকের প্রশ্ন
PR পদ্ধতি প্রথম কোথায় চালু হয়েছিল, এবং এর বিভিন্ন ধরন কি কি?
ভূমিকা
প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) ভোট পদ্ধতি পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। ভোটারদের প্রতিটি কণ্ঠ কার্যকর করার লক্ষ্য নিয়ে এটি উদ্ভাবিত হয়েছিল। প্রথমে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পি আর-এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
প্রথমে কয়েকটি দেশ এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে, এবং পরে এটি বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথম কোন দেশগুলো চালু করেছিল PR?
১. বেলজিয়াম (১৮৯৯)
বেলজিয়ামে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে PR পদ্ধতি চালু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল:
ভোট নষ্ট হওয়া কমানো
ছোট দল ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে শক্তিশালী কণ্ঠ দেওয়া
রাজনৈতিক বহুমতের ভিত্তি তৈরি করা
২. নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে PR পদ্ধতি চালু হওয়ার পর দেখা যায় যে, ছোট দলগুলোও সংসদে আসনে অংশ পায়। এতে রাজনৈতিক বহুমতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
৩. জার্মানি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি PR পদ্ধতি গ্রহণ করে। এর লক্ষ্য ছিল নবউদ্ভূত গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করা। ছোট দলগুলোও কণ্ঠ পায়, এবং ভোটের অনুপাত সংসদে প্রতিফলিত হয়।
৪. সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া
২০শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ PR-এর কোনো না কোনো রূপ ব্যবহার করতে শুরু করে। এতে ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার আরও কার্যকর হয়।
৫. নিউজিল্যান্ড (১৯৯০-এর দশক)
নিউজিল্যান্ড প্রথমে FPTP পদ্ধতি ব্যবহার করলেও, গণভোটের মাধ্যমে PR-ভিত্তিক Mixed Member Proportional (MMP) পদ্ধতি চালু করে। এতে ভোটাররা দুটি ভোট দেন:
নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট
রাজনৈতিক দলকে ভোট
এভাবে জনগণ ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের কণ্ঠ নিশ্চিত করতে পারে।
৬. ইসরাইল
ইসরাইল পুরো দেশকে একটি আসন হিসেবে গণনা করে। রাজনৈতিক দল যে ভোট পায়, সেই অনুপাতে সংসদে আসন পায়। এতে ছোট দলও সংসদে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু জোট সরকারের অস্থিতিশীলতার সমস্যা দেখা দেয়।
PR-এর ধরন
প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন একক পদ্ধতি নয়; এটি বিভিন্ন রূপে কার্যকর করা যায়। মূল তিনটি ধরন হলো:
১. লিস্ট PR সিস্টেম
ভোটাররা সরাসরি দলকে ভোট দেন।
দল যে ভোট পায়, তার অনুপাতে সংসদে আসন বরাদ্দ হয়।
দল আগে থেকেই প্রার্থী তালিকা তৈরি করে রাখে।
সুবিধা: ছোট দল ও সংখ্যালঘুরা সংসদে আসতে পারে।
উদাহরণ: নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম।
২. মিক্সড-মেম্বার প্রোপোরশনাল (MMP)
পরিচিত জার্মান মডেল নামে।
ভোটাররা দুটি ভোট দেন:
একটি নির্দিষ্ট প্রার্থীকে
একটি রাজনৈতিক দলকে
সংসদে আসন বরাদ্দ হয় দলীয় ভোটের অনুপাতে, কিন্তু প্রার্থীরাও সুযোগ পান।
উদাহরণ: জার্মানি, নিউজিল্যান্ড।
৩. সিঙ্গেল ট্রান্সফারেবল ভোট (STV)
ভোটাররা প্রার্থীদের পছন্দক্রম অনুযায়ী ভোট দেন।
প্রার্থী নির্দিষ্ট ভোটের কোটা পূরণ করলে নির্বাচিত হন; বাকি ভোট অন্য প্রার্থীর কাছে স্থানান্তরিত হয়।
সুবিধা: ভোটারদের পছন্দ আরও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
উদাহরণ: আয়ারল্যান্ড, মাল্টা।
বাংলাদেশে প্রয়োগের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ বর্তমানে FPTP পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এর সীমাবদ্ধতা:
ভোটের বড় অংশ কার্যত নষ্ট হয়
সংখ্যালঘু ও ছোট দল সাংসদে আসতে পারে না
রাজনৈতিক বহুমতের পরিবেশ তৈরি হয় না
PR পদ্ধতি চালু হলে:
ভোটের অনুপাত সংসদে প্রতিফলিত হবে
ছোট দল ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কণ্ঠ শোনা যাবে
জোট সরকার বা আপসের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সম্ভব
উপসংহার
প্রথম দেশগুলো PR পদ্ধতি চালু করে দেখিয়েছে যে, ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব ও রাজনৈতিক বহুমত তৈরি করা সম্ভব।
বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি → ভোটের অনুপাত অনুসারে আসন
নিউজিল্যান্ড → MMP সিস্টেমে সফল প্রয়োগ
ইসরাইল → ছোট দল ও সংখ্যালঘুর জন্য সুবিধা, কিন্তু জোট সরকার চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে PR প্রয়োগ করা হলে, ভোটের ন্যায্যতা বৃদ্ধি পাবে, সংখ্যালঘু ও ছোট দলও কণ্ঠ পাবে, এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হবে।
Comments
Post a Comment