প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন
"গণতন্ত্রের ধারা : পি আর পদ্ধতির বিশ্লেষণ "
[প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন ]
![]() |
"সবাই ভোট দেয়, কিন্তু কয়জনের কণ্ঠ পৌঁছায় সংসদে |
পাঠকের প্রশ্ন
সবাই ভোট দেয়, কিন্তু কতজনের কণ্ সংসদে পৌঁছায়?
ভূমিকা
গণতন্ত্র হলো মানুষের সভ্যতার এক আলোকিত মাইলফলক। ভোটাধিকার কেবল একটি সাংবিধানিক অধিকার নয়; এটি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে জনগণের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত করার সবচেয়ে সরাসরি উপায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সবাই ভোট দিলেও সব কণ্ঠ সমানভাবে সংসদে পৌঁছায় না। ছোট দল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠ প্রায়শই তেমন শোনা যায় না।
এই সমস্যার সমাধান হিসেবে জন্ম নিয়েছিল প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (Proportional Representation বা PR) পদ্ধতি—যা গণতান্ত্রিক চর্চার ইতিহাসে এক অভিনব ধারা।
FPTP-এর সীমাবদ্ধতা
১৮শ ও ১৯শ শতকের ইউরোপে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP) পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী নির্বাচিত হতো। কিন্তু এতে দেখা যেত:
ভোটের উল্লেখযোগ্য অংশ কার্যত নষ্ট হয়ে যেত।
ছোট রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে আসতে পারত না।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কণ্ঠ শোনা যেত না।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো নির্বাচনে যদি একটি ছোট দল ১০% ভোট পায় কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়, তাহলে তাদের প্রাপ্ত ভোটের কোনো অংশই সংসদে প্রতিফলিত হয় না। এই বাস্তবতা রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে।
PR পদ্ধতির উদ্ভব
১৮৫০ সালের দিকে শিল্পবিপ্লবের পর ইউরোপে সামাজিক অস্থিরতা দানা বাঁধে এবং জনসাধারণের মধ্যে নানা দাবি নিয়ে চরম মতনৈক্য পরিলক্ষিত হয় যা সমাজের শান্তি চরমভাবে বিঘ্নিত করে। নানা সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের তরফ থেকে নানা দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। এ সকল কারণে ভোট পদ্ধতি অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পাওয়া প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন ভোট পদ্ধতির প্রয়োজন দেখা দেয়। রাজনৈতিক চিন্তাবিদরা ভাবলেন, কিভাবে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করা যায় যাতে দলগুলো তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে আসন পায়। যেখানে ভোটের উল্লেখযোগ্য অংশই শুধু প্রতিফলিত হয় না, ছোট দলগুলো প্রায় বিলীন হয়ে যাবে না এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব অদৃশ্য হয়ে যাবে না।
নতুন উদ্ভাবিত এই পিআর পদ্ধতি প্রথমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় বেলজিয়ামে ১৮৯৯ সালে। এরপর একে একে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও জার্মানি প্রয়োগ করে।
PR-এর মূল উদ্দেশ্য
PR-এর মূল লক্ষ্য হলো ন্যায্যতা এবং সকলের অংশগ্রহণ ।
ভোট নষ্ট হয় না বরং সব ভোট গণনা করা হয়।
সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় ।
ক্ষুদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ে।
এটি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠই নয় বরং বিভিন্ন মত ও পথের মতাদর্শের প্রতিফলন সংসদে দেখা যায় ।
বাংলাদেশে প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে মূলত FPTP পদ্ধতি ব্যবহার হয়। এতে দেখা যায়:
ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের প্রভাব সীমিত।
ভোটের একটি বড় অংশ কার্যত নষ্ট হয়।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যদি বাংলাদেশ PR পদ্ধতি গ্রহণ করতো, তাহলে ভোটের যথাযথ অনুপাত অনুসারে ছোট দল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠও সংসদে পৌঁছাত। এর ফলে গণতান্ত্রিক ন্যায্যতা বৃদ্ধি পেত এবং রাজনৈতিক বহুমতের পরিবেশ তৈরি হতো।
উপসংহার
প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন হলো গণতন্ত্রের ভেতরে গণতন্ত্র। এটি নিশ্চিত করে যে প্রতিটি ভোট মূল্যবান এবং সব ধরনের কণ্ঠ শোনা যায়।
ইতিহাস প্রমাণ করে, সঠিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে PR পদ্ধতি জনগণের আস্থা বাড়ায়, ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের শক্তিশালী কণ্ঠ দেয়।
বাংলাদেশের মতো দেশেও এই পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে গণতন্ত্র আরও সরাসরি, ন্যায্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।
Comments
Post a Comment