প্রথম পর্ব : নেপাল: হিমালয়ের কোল ঘেঁষা এক অনন্য ভূখণ্ড
হিমালয়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা নেপাল এক বিস্ময়কর দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট এই রাষ্ট্রটি আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও তার ঐতিহাসিক গৌরব, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য পৃথিবীর মানচিত্রে তাকে আলাদা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। আকাশচুম্বী হিমালয়ের শুভ্র বরফাচ্ছাদিত শৃঙ্গ যেন নেপালের আত্মা, আর সেখান থেকেই উৎসারিত হয়েছে তার ইতিহাস, ধর্ম, অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রা।
নেপালের ভূমিরূপ
![]() |
হিমালয় পর্বত |
নেপাল একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। উত্তরে চীন এবং দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত। ভৌগোলিক দিক থেকে দেশটি তিনটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত—
১. হিমালয় অঞ্চল: উত্তরে বিস্তৃত, যেখানে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট (সাগরমাথা, উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার) অবস্থিত।
২. মধ্যাঞ্চল পাহাড়ি এলাকা: যেখানে উপত্যকা, গিরিখাত ও সবুজ বনাঞ্চল বিস্তৃত। কাঠমান্ডু উপত্যকাই এই অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র।
৩. তেরাই অঞ্চল: দক্ষিণে অবস্থিত উর্বর সমভূমি, যা ভারতের বিহার ও উত্তরপ্রদেশ সীমান্ত পর্যন্ত প্রসারিত। এই অঞ্চলই নেপালের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র।
জলবায়ু
নেপালের জলবায়ু বৈচিত্র্যময়। দক্ষিণে তেরাই অঞ্চলে উপক্রান্তীয় জলবায়ু বিরাজমান, যেখানে গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম আর শীতে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া দেখা যায়। মধ্যাঞ্চলের পাহাড়ি উপত্যকায় আবহাওয়া নরম ও মনোরম। তবে উত্তর হিমালয় অঞ্চলে শীতকালে প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে। ফলে এক দেশের মধ্যেই তিন ধরনের জলবায়ুর অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়—সমতল উষ্ণ অঞ্চল, পাহাড়ি নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল এবং পর্বতশীতল অঞ্চল।
জনসংখ্যা
নেপালের জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে এবং কৃষিভিত্তিক জীবিকা নির্বাহ করে। শহুরে জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও দ্রুত বাড়ছে, বিশেষত রাজধানী কাঠমান্ডু, পোখারা ও বিরাটনগরে।
ধর্ম
নেপাল ঐতিহাসিকভাবে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মিলনভূমি। দেশের প্রায় ৮০% মানুষ হিন্দু, তবে বৌদ্ধধর্মও নেপালের আত্মার সঙ্গে মিশে আছে। কারণ, লুম্বিনি—যেখানে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল—নেপালের পবিত্র ভূমি। এছাড়াও মুসলিম, খ্রিস্টান ও কিরাত ধর্মাবলম্বী কিছু জনগোষ্ঠী রয়েছে। ধর্মীয় সহাবস্থান নেপালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
জাতি ও গোষ্ঠী
নেপাল বহু জাতি ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এখানে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, মাগার, গুর্খা, রাই, লিম্বু, শেরপা, নিউয়ার, থারু প্রভৃতি গোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। শেরপারা হিমালয় আরোহনে তাদের সাহসিকতা ও দক্ষতার জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। আর গুর্খারা তাদের বীরত্ব ও সামরিক দক্ষতার কারণে আজও ইতিহাসে অমর।
জাতীয় সংগীত ও তার রচয়িতা
নেপালের জাতীয় সংগীত হলো “सयौं थुँगा फूलका हामी, एउटै माला नेपाली” (Sayau Thunga Phoolka Haami, Eutai Maala Nepali) অর্থাৎ “শত ফুলের মতো আমরা এক মালার নেপালি”।
এই সংগীতের রচয়িতা হলেন কবি ব্যাকুল মাইলা (প্রদীপ কুমার রায়)।
২০০৬ সালে গণআন্দোলনের পর এটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়, যা নেপালের বহুত্ববাদী চেতনা, স্বাধীনতা ও ঐক্যের প্রতীক।
রাজনৈতিক দল
নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাস অস্থিরতায় ভরা। কয়েক দশক রাজতন্ত্রের অধীনে থাকার পর দেশটি গণতন্ত্রের পথে হাঁটে। বর্তমানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হলো—
নেপালি কংগ্রেস (NC)
কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনিফাইড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট - UML)
কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওবাদী সেন্টার)
জনতা সমাজবাদী পার্টি
২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং নেপাল নিজেকে ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক ঘোষণা করে।
উপনিবেশিক শক্তির প্রভাব
ভারতের মতো নেপাল সরাসরি কোনো ইউরোপীয় শক্তির উপনিবেশে পরিণত হয়নি। তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভাব এখানে প্রবল ছিল। ১৯শ শতকে ব্রিটিশরা নেপালের সঙ্গে সুগৌলি চুক্তি (১৮১৬) করে, যার ফলে নেপাল কিছু ভূখণ্ড হারায় এবং ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে বাধ্য হয়। নেপালি সৈন্যরা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে “গুর্খা রেজিমেন্ট” হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
নেপালের স্বাধীনতা সংগ্রাম
যদিও নেপাল সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল না, তবে দেশটি দীর্ঘ সময় ধরে রানা শাসক পরিবার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে (১৮৪৬–১৯৫১)। রানা শাসকরা জনগণের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়ে স্বৈরাচার কায়েম করেছিল। ১৯৫১ সালে গণআন্দোলনের মাধ্যমে রানা শাসনের অবসান ঘটে এবং গণতন্ত্রের বীজ বপন হয়।
পরবর্তীতে গণআন্দোলন—বিশেষত ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ২০০৬ সালের জনআন্দোলন—নেপালকে রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করে। তাই নেপালের স্বাধীনতা সংগ্রাম বলতে বোঝায়—রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসন থেকে জনগণের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরে আসা।
নেপালের অর্থনীতির মূল খাত
নেপালের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। প্রায় ৬৫% মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। প্রধান ফসল ধান, ভুট্টা, গম, বাজরা ও ডাল।
অর্থনীতির অন্যান্য প্রধান খাত হলো—
1. পর্যটন: এভারেস্টসহ হিমালয়ের বিভিন্ন শৃঙ্গ, লুম্বিনি ও পোখারার মতো দর্শনীয় স্থান নেপালের পর্যটনকে সমৃদ্ধ করেছে।
2. বিদেশে কর্মসংস্থান ও রেমিট্যান্স: লক্ষাধিক নেপালি বিদেশে কর্মরত, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। তাদের পাঠানো অর্থ নেপালের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি।
3. বনসম্পদ ও জলবিদ্যুৎ: নেপাল নদীসমৃদ্ধ দেশ। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করছে।
4. হস্তশিল্প ও কারুশিল্প: কাঠের কারুকাজ, পশমী কাপড় ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পসামগ্রী নেপালের রপ্তানি আয়ের উৎস।
উপসংহার
নেপাল এক অনন্য বৈচিত্র্যের দেশ—যেখানে বরফাচ্ছাদিত হিমালয়, সবুজ পাহাড় আর উর্বর সমভূমি মিলেমিশে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক চিত্র আঁকে। ধর্মীয় সহনশীলতা, জাতিগত বৈচিত্র্য এবং স্বাধীনতার সংগ্রামী ইতিহাস তাকে করেছে আলাদা। রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও নেপাল ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক শক্তি দৃঢ় করার পথে।
নেপাল আমাদের শেখায়—আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও, সাহস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে একটি দেশ বিশ্বমঞ্চে নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় ধরে রাখতে পারে।
Comments
Post a Comment