দ্বিতীয় পর্ব : ইন্দোনেশিয়া: উপনিবেশবাদ থেকে সামরিক শাসন এবং গণতন্ত্রে উত্তরণ



ভূমিকা

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপমালা ইন্দোনেশিয়া — এক অনন্য সৌন্দর্যের দেশ। নীল সমুদ্র, সবুজ অরণ্য, আগ্নেয়গিরির অগ্নিবাণী আর সুগন্ধি মসলার ঘ্রাণে ভরপুর এই দেশটি পৃথিবীর অন্যতম সম্পদশালী ভূখণ্ড। ভৌগোলিকভাবে এটি ছিল বাণিজ্যপথের সংযোগকেন্দ্র। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি অবস্থান ইন্দোনেশিয়াকে প্রাচীনকাল থেকেই করে তুলেছিল বিশ্বের চোখে লোভনীয়।

কিন্তু প্রকৃতির এই অফুরন্ত দানই দেশটিকে এনে দেয় শৃঙ্খল—উপনিবেশের শৃঙ্খল। শত শত বছর ধরে ইউরোপীয় পর্তুগিজ, ডাচ, ব্রিটিশ এবং অবশেষে জাপানি দখলদাররা এই দ্বীপমালার বুকে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করে। আর সেখান থেকেই শুরু হয় ইন্দোনেশিয়ার দীর্ঘ সংগ্রাম—একটি জাতির বেঁচে থাকার সংগ্রাম।


উপনিবেশের শৃঙ্খল: কেন ইন্দোনেশিয়া বিদেশী শক্তির হাতে পতিত হলো?

১৫ শতকের শেষভাগে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা যখন পূর্বমুখী নৌপথ আবিষ্কার শুরু করে, তখন তারা আবিষ্কার করল এক ‘সুগন্ধি স্বর্গ’। জাভা, সুমাত্রা, মালুকু দ্বীপপুঞ্জ—এসব অঞ্চল থেকে উৎপাদিত লবঙ্গ, জায়ফল, দারুচিনি, গোলমরিচ শুধু ইউরোপ নয়, সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিকে মোহিত করেছিল।

এই সম্পদের টানে প্রথম আসে পর্তুগিজরা। তারা ১৫১১ সালে মালাক্কা দখল করে এবং ধীরে ধীরে দ্বীপমালার বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে। কিন্তু পর্তুগিজদের পরে আসে ডাচরা, যারা প্রতিষ্ঠা করে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (VOC)। ১৭শ শতক থেকে শুরু করে প্রায় ৩৫০ বছর ধরে ডাচরা ইন্দোনেশিয়াকে পরিণত করে তাদের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ডে।

ডাচ শাসনের মূল লক্ষ্য ছিল একটাই—শোষণ। কৃষকদের জমি কেড়ে নিয়ে জোরপূর্বক চাষ করানো হতো। “কালচার সিস্টেম” নামে পরিচিত এই প্রথায় কৃষকদের ধান বাদ দিয়ে কফি, আখ, তামাক, নীলচাষ, আর মসলা উৎপাদনে বাধ্য করা হতো। ক্ষুধায় কাতর মানুষ, দারিদ্র্যে জর্জরিত গ্রাম আর শোষিত কৃষক—ইন্দোনেশিয়ার প্রতিটি দ্বীপেই এক ভয়ংকর বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছিল।

কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি যত শোষিত হয়, তার অন্তরে প্রতিরোধের আগুন তত জ্বলে ওঠে।

প্রতিরোধের প্রথম আলো: বিদ্রোহ ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতা

ইন্দোনেশিয়ার জনগণ কখনোই সম্পূর্ণ নীরব ছিল না। সময়ে সময়ে তারা রুখে দাঁড়িয়েছে—

দিপোনেগোরো বিদ্রোহ (১৮২৫-১৮৩০): জাভার রাজপুত্র দিপোনেগোরো নেতৃত্ব দিলেন এক দীর্ঘ ৫ বছরের সংগ্রাম। যদিও এই বিদ্রোহ শেষে তিনি বন্দি হন, কিন্তু এটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে দেয়।

আচেহ যুদ্ধ (১৮৭৩-১৯০৪): সুমাত্রার আচেহ অঞ্চল দীর্ঘ প্রতিরোধ চালায়। প্রায় ৩০ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, তবুও আচেহবাসীর লড়াই কিংবদন্তি হয়ে ওঠে।

জাতীয়তাবাদের উত্থান (১৯০৮-এর পর): ২০ শতকের শুরুতে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন হয়। ‘বুদি উতোমো’ সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়, পরে আসে ‘সারিকেট ইসলাম’। এভাবেই ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক চেতনায় জাগরণ ঘটে।


স্বাধীনতার ঘোষণার পথে: সুকর্ণো ও হাট্টার নেতৃত্ব

১৯২৭ সালে সুকর্ণো প্রতিষ্ঠা করেন ইন্দোনেশিয়ান ন্যাশনাল পার্টি (PNI)। তিনি বিশ্বাস করতেন, একদিন এই জাতি উপনিবেশের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলবে। তার বক্তৃতা, তার সংগ্রামী জীবন লাখো তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নতুন মোড় নেয় ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস। ১৯৪২ সালে জাপান ডাচদের হটিয়ে ইন্দোনেশিয়া দখল করে। জাপানি শাসন ছিল নির্মম; খাদ্যাভাব, জোরপূর্বক শ্রম, হত্যা—সব মিলিয়ে মানুষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করে। তবু এই সময়ে সুকর্ণো ও মোহাম্মদ হাট্টা রাজনৈতিক নেতৃত্বে আরও শক্ত ভিত্তি পান।

১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্ট—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে—সুকর্ণো ও হাট্টা ঘোষণা করেন ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা। সেই ঘোষণা ছিল এক বজ্রধ্বনি, যা এশিয়ার আকাশে স্বাধীনতার মশাল জ্বালিয়ে দেয়।


মুক্তিযুদ্ধ: ডাচদের প্রত্যাবর্তন ও জনতার জয়

স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেও সংগ্রাম থেমে থাকেনি। ডাচরা আবার ফিরে এসে ইন্দোনেশিয়াকে পুনর্দখল করতে চেয়েছিল। শুরু হয় ৪ বছরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ (১৯৪৫–১৯৪৯)।

জাভা, সুমাত্রা, সুলাওয়েসি—সবখানে গেরিলা যুদ্ধ চলতে থাকে। হাজার হাজার মানুষ শহীদ হয়। আন্তর্জাতিক চাপও বাড়তে থাকে। অবশেষে ১৯৪৯ সালে নেদারল্যান্ডস ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন করলেও সমস্যার শেষ হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং বিভক্ত দ্বীপমালা এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করে।


সামরিক শাসনের ছায়া: সুকর্ণো থেকে সুহার্তো

স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট সুকর্ণো ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক নেতা। তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়ে তার নীতি পশ্চিমা শক্তির কাছে সন্দেহজনক মনে হয়। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কাছাকাছি চলে যান, আবার পশ্চিমাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেন।

১৯৬৫ সালে ঘটে এক অভ্যুত্থান—যেখানে সেনাবাহিনী ও কমিউনিস্টদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এই ঘটনার পর সেনাপ্রধান জেনারেল সুহার্তো ক্ষমতা দখল করেন। শুরু হয় দীর্ঘ সামরিক শাসন (১৯৬৭–১৯৯৮)।

সুহার্তোর শাসনে অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও তা এসেছিল কঠোর স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে। রাজনৈতিক বিরোধী দল দমন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, হাজার হাজার মানুষের হত্যাকাণ্ড—সব মিলিয়ে দেশটি রূপ নেয় এক অন্ধকার অধ্যায়ে।


উত্তরণ: জনগণের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার

কিন্তু ইতিহাসে শৃঙ্খল চিরস্থায়ী নয়। ১৯৯০-এর দশকে এশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দা ইন্দোনেশিয়াকেও কাঁপিয়ে তোলে। দুর্নীতি, বেকারত্ব, দারিদ্র্যে জনতা ক্ষুব্ধ হয়। ছাত্ররা রাস্তায় নামে, শ্রমিকরা প্রতিবাদ শুরু করে।

১৯৯৮ সালের তীব্র বিক্ষোভে সুহার্তো পদত্যাগে বাধ্য হন। এরপর শুরু হয় নতুন এক যাত্রা—গণতন্ত্রের যাত্রা।

সংবিধান সংস্কার, বহু দলীয় রাজনীতি, প্রেসের স্বাধীনতা, মানবাধিকারের স্বীকৃতি—সব মিলিয়ে ইন্দোনেশিয়া ধীরে ধীরে সামরিক শাসনের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসে। আজ এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ।

ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্র আজ কোন পথে?

১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের পর ইন্দোনেশিয়া যে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করেছিল, আজ সেটি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে পরিচিত। সেখানে রয়েছে বহু দলীয় রাজনীতি, সরাসরি জনগণের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, এবং তুলনামূলকভাবে স্বাধীন গণমাধ্যম।

তবে চ্যালেঞ্জও আছে—দুর্নীতি এবং সামাজিক বৈষম্য। তবু সুশীল সমাজ, ছাত্র আন্দোলন এবং শক্তিশালী নাগরিক অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে—মানুষ তাদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে সচেতন, এবং সরকারও জনগণের জবাবদিহির মধ্যে থাকার চেষ্টা করছে।


ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতার মূল ভিত্তি

ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতিকে বলা হয় “Emerging Giant of Asia”। দেশটি বর্তমানে জি২০ (G20)-এর সদস্য, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। তাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো—

1. প্রাকৃতিক সম্পদ – তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, স্বর্ণ, টিন, পাম তেল ইত্যাদি।

2. কৃষি ও কৃষিজ পণ্য – ধান, কফি, রাবার, কোকো, চা এবং বিশেষ করে পাম তেল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের শীর্ষে।

3. শিল্প ও উৎপাদন খাত – টেক্সটাইল, অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স।

4. পর্যটন – বালি দ্বীপসহ অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

5. সেবা খাত – ব্যাংকিং, তথ্যপ্রযুক্তি এবং নতুন স্টার্টআপ অর্থনীতি।

ডিজিটাল অর্থনীতি এখন দ্রুত এগোচ্ছে। বলা হয়, আগামী দশকে ইন্দোনেশিয়া হতে পারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ডিজিটাল হাব।


আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সম্পর্ক

ইন্দোনেশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থান তাকে বিশেষ কৌশলগত শক্তি দিয়েছে।

ASEAN (আসিয়ান): ইন্দোনেশিয়া আসিয়ানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সহযোগিতা ও কূটনীতির কেন্দ্রস্থল।

চীন: চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর, বিশেষ করে বিনিয়োগ ও অবকাঠামো প্রকল্পে (Belt and Road Initiative)। তবে দক্ষিণ চীন সাগরের ভৌগোলিক বিরোধ ইন্দোনেশিয়াকে সতর্ক রেখেছে।

যুক্তরাষ্ট্র: ইন্দোনেশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বজায় রাখছে। আমেরিকা তাদের কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখে।

ভারত ও অস্ট্রেলিয়া: ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ইন্দোনেশিয়া ভারতের সাথে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার সাথেও প্রতিরক্ষা ও শিক্ষা খাতে সম্পর্ক গভীর।

মধ্যপ্রাচ্য: বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া সৌদি আরব, কাতার, তুরস্কসহ মুসলিম বিশ্বে একটি প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর।


ভবিষ্যতের পথে ইন্দোনেশিয়া

ভবিষ্যতের ইন্দোনেশিয়াকে গড়ে তুলবে তিনটি মূল শক্তি—

1. গণতন্ত্রের পরিপক্বতা – যদি দুর্নীতি হ্রাস করা যায় এবং বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী হয়, তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও স্থিতিশীল হবে।

2. অর্থনৈতিক সংস্কার ও প্রযুক্তি – প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে প্রযুক্তি, শিক্ষা ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করলে ইন্দোনেশিয়া হবে এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি।

3. আঞ্চলিক কূটনীতি – চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে ইন্দোনেশিয়া একটি ‘ব্যালেন্সিং পাওয়ার’ হতে পারে, যা তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও মর্যাদা দেবে।

সব মিলিয়ে, ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যৎ এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার গল্প। একসময়ের উপনিবেশিত জাতি আজ নিজেদের পরিশ্রম, সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক চেতনা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব নেতৃত্বের পথে।

ইন্দোনেশিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র

১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের পর ইন্দোনেশিয়া তার রাজনৈতিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনে। আজ ইন্দোনেশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো:

1. পার্লামেন্ট (People’s Consultative Assembly – MPR, DPR, DPD)

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, যেখানে জনগণের সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বসেন।

আইন প্রণয়ন, বাজেট অনুমোদন এবং সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের।

2. রাষ্ট্রপতি ও নির্বাহী বিভাগ

রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন।

জনগণ রাষ্ট্রপতিকে সরাসরি ভোট দেয়া মানে জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি আস্থা।

3. সংবিধান আদালত ও বিচার বিভাগ

আদালত সংবিধান রক্ষা করে, রাজনৈতিক দল বা সরকারের অবৈধ কর্মকাণ্ড রুখতে পারে।

নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তি করে।

4. নির্বাচন কমিশন (KPU)

স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যা নির্বাচন পরিচালনা করে।

এর মাধ্যমে স্বচ্ছ ভোটগ্রহণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় থাকে।

5. গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ

প্রেস স্বাধীন, তবে মাঝে মাঝে চাপের মুখে পড়ে।

এনজিও, ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিক সংগঠনগুলো সক্রিয় এবং প্রায়ই সরকারের ভুল নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে।

রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা

ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখানেই।

অনেক রাজনৈতিক দলের ভেতরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব বিরাজ করে। পরিবারের প্রভাব বা অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দুর্বল।

দলীয় মনোনয়ন প্রক্রিয়া সবসময় স্বচ্ছ নয়; প্রায়ই প্রার্থী নির্বাচনে অর্থ ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ভূমিকা দেখা যায়।

তবে, নির্বাচন কমিশনের নিয়মে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের কিছুটা চর্চা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে (যেমন কংগ্রেস, অভ্যন্তরীণ ভোট)।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা

চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে কয়েকভাবে কাজ করছে—

1. নির্বাচনে অংশগ্রহণ

দলগুলো স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়মিতভাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, যা জনগণকে বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়।

2. জোট রাজনীতি

ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় সব সরকারই জোট ভিত্তিক। এতে একাধিক দল একত্রে কাজ করে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হয়।

3. নীতি ও সংস্কার

দুর্নীতি বিরোধী আইন, শিক্ষা সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন—এগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ আছে।

4. জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ

সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো সরব। তারা জনগণের দাবিগুলো সামনে আনে।


ইন্দোনেশিয়ার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী এবং গত দুই দশকে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা এখনো সীমিত; অর্থ, প্রভাব ও পরিবারতন্ত্রের আধিপত্য সেখানে প্রবল।

তবু জনগণের চাপ, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও সুশীল সমাজের সক্রিয়তা ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রকে ক্রমে আরও দৃঢ় করছে। ভবিষ্যতে দলগুলোর অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়লে ইন্দোনেশিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা আরও সুসংহত হবে।

উপসংহার

ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস যেন এক মহাকাব্য। পর্তুগিজ থেকে ডাচ, জাপানি দখল থেকে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে সামরিক শাসন, আর সেখান থেকে গণতান্ত্রিক উত্তরণ—সব মিলিয়ে এটি এক জাতির রক্ত, অশ্রু ও ত্যাগের কাহিনী।

আজকের ইন্দোনেশিয়া উন্নয়নের পথে অগ্রসরমান। তবে তাদের ইতিহাস আমাদের শেখায়—যে জাতি যতই শোষিত হোক না কেন, একদিন সে উঠে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা কখনো দান নয়, এটি সংগ্রামের ফল। আর গণতন্ত্রও একদিনে আসে না; আসে দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে।


Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প