প্রথম পর্ব : ইন্দোনেশিয়া : ভৌগোলিক অবস্থান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের কাহিনী
![]() |
ইন্দোনেশিয়ার মানচিত্র |
পৃথিবীর মানচিত্রে নীল সমুদ্রের বুক চিরে যে দেশটি অসংখ্য দ্বীপ নিয়ে ছড়িয়ে আছে, তার নাম ইন্দোনেশিয়া। হাজার বছরের ইতিহাস, প্রকৃতির অদ্ভুত সমাহার, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দেশ আজ বিশ্বপরিমণ্ডলে দৃপ্ত পদক্ষেপে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়ার গল্প কেবল ভূগোল বা অর্থনীতির গল্প নয়; এটি মানুষের অদম্য সাহস, কবিতা ও সংগীতের সুর, আর স্বাধীনতার লালিত স্বপ্নের গল্প।
ভৌগলিক অবস্থান
ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক অপার বিস্ময়। এটি এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের মাঝে, প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত। দেশটি প্রায় ১৭,০০০-এরও বেশি দ্বীপ নিয়ে গঠিত—যা পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপমালা রাষ্ট্র। এর প্রধান দ্বীপগুলো হলো জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও (কালিমান্তান), সুলাওয়েসি এবং নিউ গিনি (পাপুয়া)। রাজধানী জাকার্তা জাভা দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত।
ভূমিরূপ ও জলবায়ু
ইন্দোনেশিয়ার ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। অগ্ন্যুৎপাতমুখর আগ্নেয়গিরি, ঘন রেইনফরেস্ট, উর্বর সমভূমি ও সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপ এই দেশের প্রকৃতিকে অনন্য করে তুলেছে। “রিং অব ফায়ার”-এর অংশ হওয়ায় দেশটিতে প্রায় ১৩০টিরও বেশি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
জলবায়ু উষ্ণমণ্ডলীয়—সারা বছরই গরম ও আর্দ্রতা বিরাজ করে। দুটি ঋতু স্পষ্ট—বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুম। প্রচুর বৃষ্টিপাত, উর্বর মাটি এবং সাগরঘেরা অবস্থান কৃষি ও সামুদ্রিক জীবনের জন্য বিশেষ উপযোগী করেছে দেশটিকে।
জনসংখ্যা ও ভাষা
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের চতুর্থ সর্বাধিক জনবহুল দেশ। বর্তমানে জনসংখ্যা ২৭ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি। এই বিশাল জনগোষ্ঠী একশতাধিক জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত, যারা শতাধিক ভাষা ও উপভাষায় কথা বলে।
সরকারি ভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়া। তবে জাভানিজ, সুদানিজ, বালিনিজসহ অনেক আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত। ভাষার এই বৈচিত্র্য দেশের সংস্কৃতিকে করেছে বহুমাত্রিক।
ধর্ম
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সর্বাধিক মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। প্রায় ৮৭% মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এছাড়া খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও প্রাচীন স্থানীয় ধর্মাবলম্বীরাও এখানে বসবাস করে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বালি দ্বীপ, যেখানে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন ধর্মের সহাবস্থান ইন্দোনেশিয়ার সমাজকে বহুত্ববাদী ও সহিষ্ণু করেছে।
সাহিত্য, কবি ও সাহিত্যিক
ইন্দোনেশিয়ার সাহিত্য সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। এখানে রয়েছে প্রাচীন মৌখিক সাহিত্য, লোককথা, মহাকাব্য, আবার আধুনিক কবিতা ও উপন্যাসও।
হামকা (Haji Abdul Malik Karim Amrullah) – একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক, ধর্মচিন্তক ও ঔপন্যাসিক। তাঁর রচনায় ইসলামি দর্শন ও জাতীয়তাবাদ প্রতিফলিত হয়েছে।(
চাইরিল আনোয়ার – আধুনিক ইন্দোনেশিয়ান কবিতার জনক বলে খ্যাত। তাঁর কবিতায় স্বাধীনতার তৃষ্ণা, সংগ্রাম ও ব্যক্তিস্বাধীনতার আহ্বান স্পষ্ট।
প্রামোদিয়া আনান্তা তুর – বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তাঁর সাহিত্যে ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে সাহিত্যিক মহিমায় অমর করে রেখেছে।
উইলিব্রর্ডুস সুরেন্দ্র – নাট্যকার ও কবি, যিনি সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক দমননীতির বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছিলেন।
এই সাহিত্যিকদের হাতে ইন্দোনেশিয়ার সাহিত্য কেবল ভাষার শিল্প নয়, স্বাধীনতার অস্ত্রও হয়ে উঠেছিল।
জাতীয় সংগীত ও এর রচয়িতা
ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় সংগীত হলো “ইন্দোনেশিয়া রায়া"। এর অর্থ—“মহান ইন্দোনেশিয়া”।
এই সংগীত রচনা করেন ওয়াগে রুডলফ সুপ্রাতমান, ১৯২৮ সালে। যুবকদের সমাবেশে প্রথম এই গান পরিবেশিত হয়। গানটি খুব দ্রুত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে এবং উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী স্লোগান রূপে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
বিদেশি শক্তির আগমন ও শোষণ
ইন্দোনেশিয়ার ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদ প্রাচীনকাল থেকেই বিদেশিদের আকৃষ্ট করেছে।
আরব বণিকরা ইসলাম প্রচার ও বাণিজ্যের জন্য এখানে আসে।
পর্তুগিজরা ষোড়শ শতকে আসে মসলা (spices) দখল করতে।
এরপর ডাচরা (Netherlands) আসে এবং দীর্ঘ প্রায় ৩৫০ বছর ইন্দোনেশিয়াকে শাসন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানিরা দেশটি দখল করে।
বিশেষ করে ডাচদের শাসন ছিল অমানবিক। তারা কফি, চিনি, মসলা প্রভৃতি কৃষিপণ্য রপ্তানির জন্য বাধ্যতামূলক চাষ পদ্ধতি চালু করে, যা কৃষকদের দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করে। শ্রমের উপর নির্যাতন, সম্পদ লুণ্ঠন এবং রাজনৈতিক দমননীতি দেশটিকে রক্তাক্ত করে তোলে।
স্বাধীনতার সংগ্রাম
শোষণ ও দাসত্বের অন্ধকারে দীর্ঘ শতাব্দী কাটালেও ইন্দোনেশিয়ার জনগণ কখনো হাল ছাড়েনি।
১৯০৮ সালে “Boedi Oetomo” আন্দোলন শুরু হয়, যা জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করে।
১৯২৮ সালের যুব কংগ্রেস-এ তরুণরা এক ভাষা, এক দেশ ও এক জাতির শপথ গ্রহণ করে—যা ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের পতনের সুযোগে ১৯৪৫ সালের ১৭ আগস্ট সুকার্নো ও হাত্তা স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
ডাচরা পুনরায় দেশ দখলের চেষ্টা করলেও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অবশেষে ১৯৪৯ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
এই সংগ্রাম কেবল রাজনৈতিক ছিল না, এটি ছিল একটি জাতির আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের লড়াই।
আজকের ইন্দোনেশিয়া
আজকের ইন্দোনেশিয়া একটি বহুমুখী অর্থনীতির দেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জি-২০ সদস্য রাষ্ট্র। তবে স্বাধীনতার ইতিহাস, সাহিত্যিক উত্তরাধিকার ও বহুজাতিক সংস্কৃতি আজও জাতির প্রাণশক্তি।
ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থা
স্বাধীনতার মহামূল্যবান অর্জনের পর ইন্দোনেশিয়া যে রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলেছে, তা এক অর্থে তাদের দীর্ঘ শোষণ ও দাসত্বের প্রতিক্রিয়ায় নির্মিত। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া এবং জাতীয় ঐক্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া—এই দুই মূলনীতিই দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভিত।
ইন্দোনেশিয়া আজ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এখানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান দুজনই প্রেসিডেন্ট। সংসদীয় নয়, বরং প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে—যেখানে প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। তার মেয়াদ পাঁচ বছর, তবে দু’বারের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এই ব্যবস্থার ফলে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা যেমন বজায় থাকে, তেমনি জনগণের হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতার ভারও ন্যস্ত থাকে।
সংসদীয় কাঠামো
ইন্দোনেশিয়ার সংসদকে বলা হয় মজেলিস পারমুসিয়াওয়ারাতান রাকিয়াত। এটি মূলত জাতীয় গণপরিষদ, যা আবার দুটি কক্ষ নিয়ে গঠিত—
প্রতিনিধি পরিষদ, যেখানে বর্তমানে ৫৭৫ আসন রয়েছে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই এই কক্ষে বসেন।
আঞ্চলিক পরিষদ, যেখানে দেশের প্রতিটি প্রদেশ থেকে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয়। বর্তমানে এই কক্ষে প্রায় ১৩৬ জন সদস্য রয়েছেন।
মোট সংসদীয় আসনের সংখ্যা প্রায় ৭১১, যা ইন্দোনেশিয়ার বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বরকে প্রতিফলিত করে।
রাজনৈতিক দল ও বহুত্ববাদ
ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহুদলীয় গণতন্ত্রের উপর দাঁড়ানো। এখানে ইসলামপন্থী, জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল—সব ধারার দল মিলেমিশে কাজ করে। এর মধ্যে কয়েকটি দল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ—
ইন্দোনেশিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব স্ট্রাগল যার প্রতিষ্ঠাতা মেগাওয়াতি সুকার্নোপুত্রি, স্বাধীনতার স্থপতি সুকার্নোর কন্যা।
গোলকার পার্টি – দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী দল, সামরিক ও প্রশাসনিক শক্তির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল।
গেরিন্দ্রা পার্টি -- সাবেক সেনাপতি প্রাবোও সুবিয়ান্তোর নেতৃত্বাধীন জনপ্রিয় দল।
এছাড়াও ন্যাশনাল আওয়েকেনিং পার্টি, ন্যাশনাল ম্যান্ডেট পার্টি, ডেমোক্র্যাট পার্টি, প্রভৃতি দল রয়েছে।
এই বহুদলীয় চরিত্র ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক পরিসরকে যেমন বৈচিত্র্যময় করেছে, তেমনি মাঝে মাঝে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতারও জন্ম দিয়েছে।
নির্বাচন
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, সংসদের উভয় কক্ষ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধিদেরও নির্বাচিত করা হয়।
ভোটাধিকার লাভের ন্যূনতম বয়স ১৭ বছর, অথবা বিবাহিত হলে আরও আগে। নির্বাচন সাধারণত উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শহর থেকে গ্রাম—সবখানেই গণতন্ত্রের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য
ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতি কেবল ক্ষমতার প্রতিযোগিতা নয়, এটি এক অর্থে বহুসাংস্কৃতিক সমাজের বহিঃপ্রকাশ। ইসলামের প্রভাব প্রবল হলেও, খ্রিষ্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণও সমানভাবে বিদ্যমান। নারী নেতৃত্বও এখানে অগ্রাহ্য হয়নি—সুকার্নোর কন্যা মেগাওয়াতি সুকার্নোপুত্রি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে তা প্রমাণ করেছেন।
উপসংহার
ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস যেন এক মহাকাব্য—যেখানে ভৌগোলিক সৌন্দর্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, কবি-সাহিত্যিকের কণ্ঠস্বর এবং স্বাধীনতার অগ্নিগর্ভ সংগ্রাম মিলেমিশে এক অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপমালা রাষ্ট্রটি আমাদের শেখায়—দীর্ঘ শোষণ ও দমননীতি সত্ত্বেও জাতীয় ঐক্য, সাহস ও সংস্কৃতির শক্তিতে একটি জাতি স্বাধীন হতে পারে।
Comments
Post a Comment