চতুর্থ পর্ব : সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনামের ব্যতিক্রমী যাত্রা ও গণতন্ত্রের সম্ভাবনা


গণতন্ত্র নিয়ে কথা বললেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে বহুদলীয় ব্যবস্থা, সংসদে তর্ক-বিতর্ক আর নাগরিকদের ভোটাধিকার চর্চার ছবি। কিন্তু ভিয়েতনাম এক ভিন্ন কাহিনী বলে—যেখানে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র নেই, তবুও উন্নয়ন, সমৃদ্ধি আর অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। ঔপনিবেশিক শাসন, দীর্ঘ যুদ্ধ আর দারিদ্র্যের অন্ধকার পেরিয়ে আজ ভিয়েতনাম এশিয়ার অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। এখানে রাজনৈতিক বহুদলীয় প্রতিযোগিতা নেই, কিন্তু আছে বাস্তবমুখী নীতি, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং জনগণের অক্লান্ত পরিশ্রম। এই হলো সেই গল্প, যেখানে সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেও একটি দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।


ইতিহাসের প্রেক্ষাপট

ভিয়েতনামের আধুনিক পথচলা বোঝার জন্য এর অতীতের দিকে তাকাতে হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা বিদেশি শাসনের অধীনে থেকেছে—প্রথমে চীনা, পরে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে হো চিন মিনের নেতৃত্বে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়, এবং অবশেষে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভাঙে। কিন্তু স্বাধীনতার পরও শান্তি আসেনি; শুরু হয় আদর্শগত বিভাজন। উত্তর ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট মতাদর্শে, আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম পুঁজিবাদী প্রভাবের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই দ্বন্দ্ব রূপ নেয় ভিয়েতনাম যুদ্ধে—যুদ্ধের ভয়াবহতায় দেশ জর্জরিত হয়, অবকাঠামো ধ্বংস হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।

১৯৭৫ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীভূত হয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ভিয়েতনাম নামে। কিন্তু ঐক্যের পর দেশটি প্রবল সংকটে পড়ে। কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি দুর্বল, শিল্প থমকে গেছে, আর জনগণ ক্ষুধায় কাতর। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা তাদের দুরবস্থা আরও বাড়িয়ে দেয়। আশির দশকের শুরুতে ভিয়েতনাম ছিল বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির একটি। অথচ এই দুঃসময় থেকেই জন্ম নেয় পরিবর্তনের প্রত্যয়।


Đổi Mới (ডই মোই) নীতি: উন্নয়নের এক নব দিগন্ত 

১৯৮৬ সালে ভিয়েতনামের নেতৃত্ব চালু করে Đổi Mới বা “নবায়ন” নীতি। এটি ছিল এমন একটি মোড় ঘোরানো পদক্ষেপ যা দেশের ভবিষ্যৎকে নতুন করে গড়ে তোলে। সমাজতন্ত্রকে অস্বীকার না করে তারা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে বাজারভিত্তিক সংস্কারের পথ খুঁজে বের করে। লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার—অর্থনীতি উন্মুক্ত করা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দেওয়া এবং বিশ্ববাজারের সঙ্গে একীভূত হওয়া, তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাধান্য বজায় রাখা।

ডই মোইয়ের সাফল্যের রহস্য ছিল এর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি। অচল মতাদর্শ আঁকড়ে না ধরে তারা নমনীয়তার পথ বেছে নেয়। কৃষকদের জমি ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়, ব্যবসায়ীদের আরও স্বাধীনতা দেওয়া হয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানানো হয়। আর এর ফলস্বরূপ শুরু হয় উন্নয়নের বিস্ময়কর যাত্রা।


যে নীতিগুলো আধুনিক ভিয়েতনামকে গড়েছে

১. কৃষি সংস্কার ও খাদ্য নিরাপত্তা

ডই মোই-এর পর কৃষকদের জমি চাষের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। কৃষি উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ভিয়েতনাম খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। বরং তারা ধান রপ্তানিকারক শীর্ষ দেশগুলির একটি হয়ে ওঠে। ক্ষুধার্ত দেশ থেকে খাদ্য রপ্তানিকারকে পরিণত হওয়া ছিল ভিয়েতনামের অন্যতম বড় সাফল্য।

২. বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ

ভিয়েতনাম অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আহ্বান জানায়। সস্তা শ্রমশক্তি, স্থিতিশীল নীতি এবং ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকা অবকাঠামো বিদেশি কোম্পানিগুলোকে টেনে আনে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর এবং ইউরোপীয় দেশগুলির বহু প্রতিষ্ঠান ভিয়েতনামে শিল্প কারখানা গড়ে তোলে।

৩. শিল্পায়ন ও রপ্তানি-ভিত্তিক অর্থনীতি

টেক্সটাইল, জুতা, ইলেকট্রনিক্স, কফি ও সামুদ্রিক খাদ্যে ভিয়েতনাম বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। তারা বুঝতে পেরেছিল, শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ নয়, বৈদেশিক বাজারই উন্নয়নের চাবিকাঠি।

৪. শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন

ভিয়েতনাম শিক্ষা খাতে বিশেষ জোর দিয়েছে। গ্রামীণ শিশুদের স্কুলে নিয়ে আসা, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষায় বিনিয়োগের ফলে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হয়েছে। এরাই আজ দেশের শিল্প ও প্রযুক্তি খাতের মূল চালিকাশক্তি।

৫. সামাজিক খাতে বিনিয়োগ

স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন—সবখানে রাষ্ট্র বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমেছে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে।

৬. বিশ্ববাজারে সংযুক্তি

ভিয়েতনাম বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) ও বিভিন্ন আঞ্চলিক চুক্তিতে যুক্ত হয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। তারা প্রমাণ করেছে, সমাজতান্ত্রিক দেশ হয়েও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব।


সমাজতন্ত্র ও উন্নয়নের সেতুবন্ধন

ভিয়েতনামের উন্নয়নের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো তাদের সামঞ্জস্য খুঁজে বের করার ক্ষমতা। তারা সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো বজায় রেখেছে, কিন্তু অর্থনৈতিক নীতি করেছে মুক্তবাজারমুখী। একদিকে কমিউনিস্ট পার্টির দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ, অন্যদিকে জনগণের জীবনমান উন্নত করার বাস্তবসম্মত উদ্যোগ—এই দ্বৈত চরিত্রই তাদের উন্নতির মূল চাবিকাঠি।


আজকের ভিয়েতনাম

আজ ভিয়েতনাম দারিদ্র্যের শৃঙ্খল প্রায় ভেঙে ফেলেছে। আশির দশকে যেখানে জনগণের অর্ধেকের বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, আজ সেটা নেমে এসেছে ৫%-এর নিচে। দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শহরগুলোতে উঁচু ভবন, ব্যস্ত শিল্পাঞ্চল, আধুনিক সড়ক—সবই তাদের অগ্রগতির সাক্ষী। কিন্তু তারা এখনও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, গ্রামীণ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।


গণতন্ত্রের স্বাভাবিক উন্মেষ

মানবসভ্যতার ইতিহাস আমাদের শেখায়—গণতন্ত্র কোনো শাসকের উপহার নয়, বরং এটি জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। ইউরোপে একসময় ছিল রাজাদের সর্বময় আধিপত্য, কিন্তু শিল্পবিপ্লব ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান সেখানে গণতন্ত্রের বীজ বপন করে। ফ্রান্সের বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা ইউরোপের অন্যান্য গণআন্দোলন—সবকিছু মিলিয়ে ধীরে ধীরে একটি প্রাতিষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে ওঠে। লাতিন আমেরিকায় সামরিক শাসনের পতনের পর গণতন্ত্রের অঙ্কুরোদ্গম ঘটে। আবার এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া বা তাইওয়ানের মতো দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরি করে, তখনই সেই শ্রেণী রাজপথে নেমে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দাবি করে।

অর্থাৎ, সাধারণত যুদ্ধ, বিপ্লব, বা স্বৈরশাসনের পতনের পর গণতন্ত্র বিকশিত হয়।


ভিয়েতনামের ভিন্ন পথ

কিন্তু ভিয়েতনামের গল্প ভিন্ন। শত বছরেরও বেশি বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই শেষে যখন দেশ একত্রিত হলো, তখন গণতন্ত্রের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হলো কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক একদলীয় ব্যবস্থা। জনগণ স্বাধীনতা পেলেও তারা বহুদলীয় প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতির স্বাদ পেল না।

তবু বিস্ময়করভাবে—এই ব্যবস্থার ভেতর থেকেই ভিয়েতনাম অর্থনৈতিক রূপান্তরের পথ বেছে নিল। ১৯৮৬ সালের Đổi Mới সংস্কার ছিল সেই যাত্রার সূচনা, যা সমাজতান্ত্রিক আদর্শ বজায় রেখেই বাজারমুখী অর্থনীতির দ্বার খুলে দিল।

যেখানে অন্য অনেক দেশে উন্নয়নের পূর্বশর্ত ছিল গণতন্ত্র, সেখানে ভিয়েতনামে উন্নয়ন এলো গণতন্ত্র ছাড়াই।


মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও গণতান্ত্রিক চেতনা

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যখন কোনো দেশে শিক্ষা, নগরায়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, তখনই তৈরি হয় নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই শ্রেণী সাধারণত শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নে সন্তুষ্ট থাকে না; তারা চায় স্বাধীন মতপ্রকাশ, অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি ও মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা।

আজ ভিয়েতনামে সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী দ্রুত বাড়ছে। হ্যানয়, হো চি মিন সিটি কিংবা দা নাং-এর নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তি, তথ্যপ্রবাহ ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে। প্রশ্ন হলো—তাদের হৃদয়ে কি গণতন্ত্রের বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে? নাকি অর্থনৈতিক সাফল্যের মোহে রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি আপাতত ম্লান হয়ে আছে?


বৈশ্বিক চাপ ও প্রযুক্তির যুগ

২১শ শতাব্দী তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া ভিয়েতনামের তরুণদেরও বাইরের পৃথিবীর সাথে যুক্ত করেছে। তারা আমেরিকা, ইউরোপ বা প্রতিবেশী দেশগুলোর গণতান্ত্রিক বাস্তবতা দেখে।

পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অংশীদাররা, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে। চীনের মতো কৌশলগত মিত্র থাকলেও ভিয়েতনামের বৈশ্বিক বাণিজ্য নির্ভরশীল পশ্চিমা বাজারে। তাই বৈশ্বিক চাপ একদিন হয়তো ভিয়েতনামকে রাজনৈতিক সংস্কারের দিকে ঠেলে দিতে পারে।


ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংকট

এখন পর্যন্ত ভিয়েতনামের পথ মসৃণ মনে হচ্ছে কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন জনগণকে সন্তুষ্ট রেখেছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই পথ কতটা টেকসই?

যদি জনগণের জীবনমান উন্নতির গতি কমে যায়, তখন রাজনৈতিক অধিকারহীনতা নিয়ে অসন্তোষ জমতে পারে।

যদি শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দাবি করে, শাসক দল কি সেই কণ্ঠস্বর শোনবে, নাকি দমন করবে?

ইতিহাস বলে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চিরকাল রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব ঢাকতে পারে না।


ভিয়েতনামের সামনে দ্বিমুখী পথ

ভবিষ্যতে ভিয়েতনামের সামনে দুটি সম্ভাব্য পথ খোলা—

১. চীনের পথ: উন্নয়ন বজায় রেখে একদলীয় শাসনকে আরও শক্তিশালী করা।

২. দক্ষিণ কোরিয়া/তাইওয়ানের পথ: একসময় অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে গণতান্ত্রিক সংস্কারও ঘটানো।

কোন পথে যাবে ভিয়েতনাম—তা নির্ধারণ করবে তাদের জনগণ, নেতৃত্ব, এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট।

অ্যাড করার মতো বাড়তি অংশ


১. গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের ধারাপাত

গণতন্ত্র কখনো হঠাৎ করে আসে না। এটি সাধারণত দীর্ঘ সংগ্রাম, আন্দোলন, শাসনব্যবস্থার পতন, কিংবা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়। ইউরোপীয় দেশগুলোর অভিজ্ঞতা আমাদের বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর নতুন করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রগুলো গণতন্ত্রকে গ্রহণ করে নিজেদের উন্নয়নের পথ খুলে দেয়। আবার দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান কিংবা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে দেখা যায়—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূল চালিকাশক্তি হয়েছে।


২. ভিয়েতনামের ব্যতিক্রমী যাত্রা

কিন্তু ভিয়েতনাম ভিন্ন। এখানে বিদেশি দখলদারদের পতন ঘটেছে, কিন্তু তার ফলে গণতান্ত্রিক বহুদলীয় ব্যবস্থা আসেনি। বরং প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন একদলীয় কাঠামো। এ ব্যবস্থার ভেতর থেকেই দেশ অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করে এবং উন্নতির পথে এগোতে থাকে। অর্থাৎ, যেখানে অন্য দেশে গণতন্ত্র উন্নয়নের পূর্বশর্ত ছিল, ভিয়েতনামে উন্নয়ন এসেছে গণতন্ত্র ছাড়াই।


৩. অর্থনীতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

আজ ভিয়েতনামের অর্থনীতি দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে গড়ে উঠছে নতুন এক মধ্যবিত্ত সমাজ, যাদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে, দিগন্ত প্রসারিত হচ্ছে। ইতিহাস বলে, এই শ্রেণীই সাধারণত রাজনৈতিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ দাবি করে থাকে। ভিয়েতনামেও একসময় এই দাবি উঠতে পারে। প্রশ্ন হলো—শাসক দল কি তখন সংস্কার করবে, নাকি আরও কঠোর হবে?


৪. বৈশ্বিক চাপ ও তথ্যপ্রবাহের প্রভাব

বিশ্ব ক্রমেই সংযুক্ত হচ্ছে। ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণরা পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারা সম্পর্কে অবহিত হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অংশীদাররা—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন—মানবাধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলতে পারে। এই বৈশ্বিক চাপ ভবিষ্যতে ভিয়েতনামের জন্য এক ধরণের পরীক্ষার কারণ হবে।


৫. পথ কতটা মসৃণ?

এখন পর্যন্ত ভিয়েতনামের পথ মসৃণ কারণ উন্নয়ন হচ্ছে এবং জনগণ তার সুফল পাচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নের সাথে সাথে চাহিদাও বাড়বে—শিক্ষা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। তখন শাসনব্যবস্থা যদি এই চাহিদাকে উপেক্ষা করে, তবে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব জমতে শুরু করবে। ইতিহাস বলে, অর্থনীতি দিয়ে জনগণকে দীর্ঘদিন চুপ রাখা যায় না। তাই ভিয়েতনামের জন্য প্রকৃত চ্যালেঞ্জ আসবে তখনই, যখন উন্নত সমাজ একদিন রাজনৈতিক উন্নতির দাবি করবে।


উপসংহার

ভিয়েতনামের গল্প হলো দুঃখ থেকে আশার গল্প, অন্ধকার থেকে আলোর গল্প। এটি প্রমাণ করে যে উন্নয়নের জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্র অপরিহার্য নয়, বরং সঠিক নেতৃত্ব, দূরদর্শী নীতি ও জনগণের অংশগ্রহণই আসল চালিকা শক্তি। ভিয়েতনাম আমাদের শেখায়—কোনো দেশ যদি নিজস্ব বাস্তবতাকে বুঝে সেই অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করে, তবে সমাজতন্ত্রের মধ্যেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব।


Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প