সপ্তম পর্ব : ফিলিপাইনস: গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও চ্যালেঞ্জ


ফিলিপাইনসের ইতিহাস এক লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস । এটি একটি দেশের সংগ্রামের গল্প, যেখানে জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে। কখনো সেনা শাসনের বিরুদ্ধে, কখনো রাজনৈতিক দুর্বলতা ও শোষণের  বিরুদ্ধে । এই ব্লগে আমরা ফিলিপাইনসের রাজনৈতিক ইতিহাস, অগণতান্ত্রিক শাসনের সময়কাল, সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের ভূমিকা বিশ্লেষণ করব।


মার্কোস যুগ: সেনা শাসন ও একনায়কতন্ত্র



স্বৈরশাসক মার্কেসের বিরুদ্ধে ফিলিপিনো  জনগণের বিক্ষোভ 

১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস ঘোষণা করেন “প্রোক্লামেশন নং ১০৮১”, যা দেশকে মার্শাল ল’ শাসনের অধীনে নিয়ে যায়। এর ফলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ বা দমন করা হয়,।সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনার স্বাধীনতা সীমিত করা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক বন্দীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

মার্কোসের  চৌদ্দ বছর এক নায়ক তান্ত্রিক সেনা শাসনের সময়ে সেনারা দেশের রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। তখন গণতান্ত্রিক  প্রক্রিয়া প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায় ।


রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের প্রতিরোধ

গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের অবদান ছিল অপরিসীম।

রাজনৈতিক দলের ভূমিকা

মার্কোস কে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলো সংগঠিত হয়ে  জনসংযোগ, নির্বাচনী প্রচারণা, জনসভা, এবং শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ আয়োজন করে। তারা  জনগণকে তাদের অধিকার ও ভোটের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। 


সুশীল সমাজের ভূমিকা

শিক্ষাবিদ, নাগরিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো জনগণকে সচেতন করেছিল। তারা স্থানীয় পর্যায়ে নাগরিক পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিল।   যেমন --‘Concerned Citizens of Abra for Good Governance (CCAGG)’ স্থানীয় সরকারের উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করেছিল।

এই সকল  সমন্বিত প্রচেষ্টাই ফিলিপাইনসকে মার্কোসের একনায়কতন্ত্রের পতন  ত্বরান্বিত করে ।


পিপল পাওয়ার রেভোলিউশন (1986)

১৯৮৬ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফিলিপাইনসের জনগণ পিপল পাওয়ার রেভোলিউশন চালায়। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনে লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে।চার্চের মত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সংবাদমাধ্যম জনগণের পাশে দাঁড়ায়লাফল স্বরুপ  মার্কোস ক্ষমতাচ্যুত হন এবং করজিন কুইজো রাষ্ট্রপতি হন।

এই আন্দোলন দেখিয়েছে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করা শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জনগণ ও সামাজিক আন্দোলনের একত্রিত শক্তি প্রয়োজন।


1987 সালের সংবিধান: গণতন্ত্রের ভিত্তি

গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর নতুন সংবিধান (1987) প্রণয়ন করা হয় যার  মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ----

 নাগরিক দের মানবাধিকার ও  বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ তথা সেনাদের বেসামরিক সরকারের অধীনে আনা।

রাষ্ট্রক্ষমতার ভারসাম্য আনায়ন অর্থাৎ  রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ যেমন নির্বাহী বিভাগ,  আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যনিশ্চিত করা। 

জনগণের  ভোটাধিকারনিশ্চিত করা  ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

 গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা যা গণতন্ত্র পুনঃ  প্রতিষ্ঠায়  একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত হয়।


নির্বাচন কমিশন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া

নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। সুশীল সমাজ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের মাধ্যমে আবাদ, গ্রহণযোগ্য এবং  শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটের নিশ্চয়তা বিধান  করে। 

যদিও মাঝে মাঝে  রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মিডিয়ার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু  নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, তথ্য অধিকার কমিশন ও জনসচেতনতা এবং যথাযথ আইনি ব্যবস্থার ফলে গণতন্ত্র সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে। মূলত নির্বাচন কমিশনে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার মূল কারিগর। 


সেনা ও অগণতান্ত্রিক চ্যালেঞ্জ

মার্কোসের পরও ফিলিপাইনসের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে:

1989 কোটাবাতো বিদ্রোহ সংগঠিত হয়  যেখানে  সেনারা নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকার করে।

মার্কোস- পতনের পরে সামরিক চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে, কখনও কখনও সেনারা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে।তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা  , সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন ও রাষ্ট্রপতি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। 


বর্তমান চ্যালেঞ্জ

আজও ফিলিপাইনসের গণতন্ত্র কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি:

ভোট প্রক্রিয়ায় জাল ভোট ও তথ্য বিকৃতির সমস্যা।

রাজনৈতিক দফতর ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ।

সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির প্রয়োজন।


উপসংহার

ফিলিপাইনসের ইতিহাস আমাদের শেখায় যে গণতন্ত্র কেবল সংবিধান বা নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে টিকে থাকে না।

এটি জনগণ, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমাগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা যায়। মার্কোসের একনায়কতন্ত্র থেকে পিপল পাওয়ার রেভোলিউশন পর্যন্ত ইতিহাস দেখায়, গণতন্ত্রকে রক্ষা করা একটি দীর্ঘ, সংগ্রামী এবং সচেতন প্রক্রিয়ার অংশ।শন্তিপূর্ণ আন্দোলন, রাজনৈতিক সচেতনতা, এবং সামাজিক অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।সুশীল সমাজ ও কমিশন জনগণকে সংগঠিত করে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেয়। শিক্ষিত ও সচেতন জনগণ, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি  ভবিষ্যতে ফিলিপাইনসের গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করবে।






Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প