চতুর্থ পর্ব : দেশে দেশে পি আর পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক


"গণতন্ত্রের ধারা : পি আর পদ্ধতির বিশ্লেষণ "

[চতুর্থ পর্ব  : দেশে দেশে পি আর পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক ]




পাঠকের প্রশ্ন


পি আর পদ্ধতি সব দেশে সফল হয়েছে কি? কোথায় এ পদ্ধতি  নিয়ে  বিতর্ক  হয়েছে?





ভূমিকা




পি আর পদ্ধতি হলো সকলের  মতামতের প্রতিফলনের  জন্য একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা। তবে ইতিহাস দেখিয়েছে, প্রতিটি দেশেই এই পদ্ধতির  সফলতা সমান নয়। কোন কোন দেশে দেশে এটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে  , জোট সরকার নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি  হয়েছে এবং  বড় দলের উপরে  ছোট দলের আধিপত্য সৃষ্টি করেছে।


এখানে উদাহরণ হিসেবে  ইসরাইল, ইতালি এবং শ্রীলঙ্কার কথা বলা যায়। 





ইসরাইল: ছোট দলের আধিপত্য ও জোট সরকারের চ্যালেঞ্জ


ইসরাইলে পুরো দেশকে একটি আসন হিসেবে গন্য করা হয় এবং  প্রতিটি রাজনৈতিক দল যে ভোট পায়, সে অনুপাতে সংসদে আসন নির্ধারিত হয়। যার ফলে সংসদে অনেক ছোট দল প্রবেশ করে।ছোট দলগুলো তখন বড় দল গুলোর সাথে দর কষাকষিতে লিপ্ত হয়  এবং প্রায়ই সরকার গঠন নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থার তথা  সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। 



উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ১৯৯০-এর দশকে এক নির্বাচনে ১০–১২টি ছোট দল সংসদে প্রবেশ করেছিল। ফলে সরকার গঠনে বড় দল গুলোকে ছোট দলগুলোর সাথে দীর্ঘ আলোচনা ও আপসকরে সরকার গঠন করতে হয়েছিল । তখন সরকারের  নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বেশ  বিলম্ব ঘটেছিল


ইজরায়েলের ক্ষেত্রে সরকার গঠন নিয়ে এরকম অচলাবস্থা এবং  মেয়াদ পূর্তির আগেই সংসদ  ভেঙে যাওয়া, বারবার নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া  এটি অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অনেকে এক্ষেত্রে পি আর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়াকে   দায়ী করছেন। 




ইতালি: দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা


ইতালি দীর্ঘদিন ধরে পি আর  পদ্ধতি ব্যবহার করছে।ফলে ছোট দলগুলোর আধিপত্য বেড়ে যাওয়ায় সরকার গঠন নিয়ে বড় দলগুলো  প্রায়শই জটিল হয়ে পড়ে। প্রায়ই  রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে   প্রায়ই  সরকারের পতন ঘটে, সংসদ ভেঙে যায় এবং বারবার নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 



উদাহরণ হিসেবে  বলা যায় ইউরোপের দেশ ইতালিতে ১৯৮০–৯০-এর দশকে একাধিক ছোট দল মিলে  জোট গঠন করলেও সরকার দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয়নি। এতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা  তৈরি হয়, স্বল্প মেয়াদের সরকার জনগণের জন্য প্রত্যাশিত   পরিকল্পনা প্রণয়ন, উন্নয়ন এবং অগ্রগতি অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং সরকারের উপর  নাগরিকদের আস্থা কমে যায়।





শ্রীলঙ্কা: পি আর ও অন্যান্য প্রসঙ্গ 


 দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় পি আর পদ্ধতিতে জাতীয়  ও স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেখানে দীর্ঘ রাজনৈতিক বিরোধ এবং সহিংসতার ইতিহাস রয়েছে। ভোটাররা পি আর সিস্টেমের সুবিধা গ্রহণ করলেও, জাতিগত ও রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয়েছে। এছাড়াও সরকার গঠন ও নীতি প্রণয়নে অচলাবস্থা বিরাজ করছে।



উদাহরণ হিসেবে বলা যায়৷  শ্রীলঙ্কায় ২০০০ সালের  নির্বাচনে বিভিন্ন ছোট দল ও নানা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হলেও, জাতিগত উত্তেজনা ও জোট বদ্ধভাবে  প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করে সরকার গঠন নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয় ।এরকম পরিস্থিতিতে জোট সরকারের অন্যান্য অংশীদারদের  বিরোধের কারণে সরকারের কার্যকারিতা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়  এবং সরকারের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। 





সাধারণ বিতর্ক এবং চ্যালেঞ্জ


পি আর পদ্ধতির মূল সীমাবদ্ধতাগুলো হলো:

1. সংসদে অনেক  ছোট ছোট দলের প্রতিনিধিত্ব থাকে ফলে  সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়। 

2.একাধিক দলের সাথে  আপস করতে হয় বলে  সরকার দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হয় না। জোট সরকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। 

3. এই পদ্ধতিতে ভোটার  সরাসরি প্রার্থীকে নয়, দলকে ভোট দেয় ফলে  প্রতিনিধির সাথে ভোটারের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায় 




এই চ্যালেঞ্জ গুলো তুলনামূলকভাবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজমান  এমন  সংস্কৃতির দেশগুলোতে সহজে  সামলে নেয়া যায় । তবে যেখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রবল, সেখানে পিআর পদ্ধতি বিতর্কের  জন্ম দেয় ।





বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিকতা


বাংলাদেশের জন্য এই উদাহরণগুলো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়:

ছোট দল ও সংখ্যালঘুদের কণ্ঠ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে

PR চালু হলেও জোট সরকার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিবেচনা করে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন

ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যে সরাসরি সংযোগ বজায় রাখা জরুরি



উদাহরণ: বাংলাদেশে যদি PR গ্রহণ করা হয়, তাহলে ছোট দল ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কণ্ঠ শক্তিশালী হবে, কিন্তু জোট সরকার গঠনের জন্য নিয়মিত আপস এবং সমঝোতার প্রয়োজন হবে।





উপসংহার


এটা অনস্বীকার্য যে  পি আর  পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভোটারদের মতামতের  সর্বোচ্চ প্রতিফলন করার চেষ্টা করেছে  কিন্তু সব দেশে এটি সমানভাবে  সফলতা অর্জন করতে পারেনি। এক্ষেত্রে  উপরে উল্লিখিত ইসরাইল, ইতালি এবং শ্রীলংকার কথা বলা যায়। যেখানে  জোট সরকারের উপরে ছোট ছোট দলগুলোর আধিপত্য করতে দেখা গিয়েছে, সরকার গঠন নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে অচলাবস্থা চলেছে, মেয়াদ পূর্তির আগেই সরকার ভেঙে গেছে, বারবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, জাতিগত দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে, রাজনৈতিক বিভাজন এবং সহিংসতার জন্ম নিয়েছে। 



বাংলাদেশ প্রসঙ্গে  পি আর  পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে  ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই  সরব রয়েছে তাদের যুক্তি হল , বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দলগুলো  একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার  কারণে  নানা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দেয়, তারা যখন তখন নিজেদের প্রয়োজনে সংবিধান এবং আইনের পরিবর্তন ঘটায়, যেখানে সাধারন মানুষ এবং ছোট দলগুলোর কোন  মতামতের তোয়াক্কা তারা করে না। তাদের স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে বারবার রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং জনগণের জান মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি  হয়। এরকম পরিস্থিতিতে  তাদের দাবি হলো  পি আর পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সকলের  ন্যায্যতা, অন্তর্ভুক্তি ও রাজনৈতিক বহুমত নিশ্চিত হবে। তবে অনেকেই আবার এই আশঙ্কা করছেন যে, জোট সরকারের স্থিতিশীলতা এবং ভোটার-প্রার্থী সম্পর্কেও বাংলাদেশের পরিকল্পনা প্রণয়নকারীদের  বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।






Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প