ষষ্ঠ পর্ব: ৯০ এর গণআন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সফলতা ও ব্যর্থতা (১৯৯১–২০০৮)

 



বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী, বেগম খালেদা জিয়া 


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এক অদ্ভুত কাব্য। এতে যেমন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আশা–আকাঙ্ক্ষা আছে, তেমনি আছে হতাশার অন্ধকার, ষড়যন্ত্রের ছায়া ও বিভাজনের ক্ষতচিহ্ন। স্বাধীনতার দুই দশক পেরিয়ে, ১৯৯০-এর শেষপ্রান্তে যখন জনগণ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জেগে উঠল, তখন সবার কণ্ঠেই ধ্বনিত হচ্ছিল—“গণতন্ত্র চাই, ভোটাধিকার চাই, ন্যায় চাই।”


এরশাদ পতন ও তিন দলের ঐক্য 

 

৬ ডিসেম্বর , ১৯৯০  কনকনে শীত —ঢাকার রাজপথ যেন জনসমুদ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে গ্রামবাংলার মাটিও কেঁপে উঠেছিল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ প্রধান দলগুলো ইতিহাসের প্রয়োজনে প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধ হলো। সামরিক শাসকের পতন ঘটিয়ে দেশকে আবার বেসামরিক গণতন্ত্রের পথে আনার জন্য এ ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ।


এরশাদের পতন শুধু একজন শাসকের বিদায় ছিল না—এ ছিল দীর্ঘদিনের দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের জয়োল্লাস।  তিন দলের মনোনীত প্রার্থী  প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান করে  নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়  চা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে বেশ পরিচিতি পায়। দীর্ঘ তিন মাস  নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে সরকার পরিচালনা করে  ১৯৯১ সালের  ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম  সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন  অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা  লাভ করতে না পারলেও জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বেগম খালেদা জিয়া। অনেক স্বপ্ন আর  আকাঙ্ক্ষার এই সরকারকে সবাই অভিনন্দন জানালো। সম্পূর্ণ নতুন এক বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হল। 


সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন


১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হলো, কিন্তু জনগণ শিগগিরই বুঝতে পারল—শুধু ব্যবস্থার নাম বদলালেই সব সমস্যার সমাধান হয় না।


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠল তখনই। কারণ নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা ছিল নড়বড়ে। বিশেষ করে ১৯৯৪ সালের কুখ্যাত মাগুরা উপনির্বাচন—যেখানে প্রকাশ্য ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠল—তারপর থেকে মানুষের মনে প্রশ্ন জেগে উঠল: “এ নির্বাচনে সত্যিই কি জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয়?”


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্ম


আওয়ামী লীগ তখন সংসদে, কিন্তু দাবি তুলল—“একইসাথে দলীয় সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।” বিএনপি শুরুতে তির্যক মন্তব্য করল—“তাহলে কি স্বর্গ থেকে কেউ এসে নির্বাচন পরিচালনা করবে?”  " পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয় "ইত্যাদি ইত্যাদ।  কিন্তু মাগুরার বিতর্কিত উপনির্বাচন  সারাদেশের জনমত বিএনপিকে চাপে ফেলল। 


 ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ —বিএনপি একতরফা নির্বাচন করল। ভোটকেন্দ্রগুলো প্রায় ফাঁকা, বিরোধীরা বর্জন করল। মাত্র  ১৩ দিনের সংসদ স্থায়ী হলো, আর সেটিই প্রমাণ করল—গণতন্ত্র কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই। 


শেষ পর্যন্ত বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিতে বাধ্য হলো। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে  তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বিল উত্থাপন করে এবং সংসদে তা পাস হয়। এভাবেই সংবিধানে যুক্ত হলো এক ঐতিহাসিক অধ্যায়—নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।


আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরা



দীর্ঘ ২২ বছর পরে দ্বিতীয় মেয়াদে  আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়  ফেরা,প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, (১৯৯৬)  


১২ জুন, ১৯৯৬—২২ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। শেখ হাসিনা তখন এক নতুন প্রতিশ্রুতির কণ্ঠস্বর। কৃষি, শিক্ষা, গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থা, বয়স্কভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা—সব কিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া দেখা গেল।


একইসাথে এ সময়ে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণে গঠিত হলো জাতীয় ঐক্যমন্ত্রী সরকার—যা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন দৃষ্টান্ত।


কিন্তু সব অর্জনের আড়ালেও ছায়া নামল। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দলীয় সহিংসতা, বিরোধীদল দমনে কঠোর অবস্থান—এসব কারণে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে লাগল।


চারদলীয় জোটের উত্থান


২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি (একাংশ) ও ইসলামী ঐক্যজোট মিলে গঠন করল চারদলীয় জোট। তাদের প্রচারণা ছিল জোরালো, আর বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ তাদের বিজয়ের পথ প্রশস্ত করল।


ফলাফল—বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু শুরু থেকেই বিতর্ক। বিচারপতির অবসর বয়স বাড়ানো, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কে এম হাসানের নাম প্রস্তাব, আওয়ামী লীগের আপত্তি—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থা।


সংকট ও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার


২০০৬ সালের শেষপ্রান্তে দেশ অচল হয়ে পড়ল। রাস্তায় মিছিল, অবরোধ, সংঘর্ষ। সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে—যানবাহন থেমে আছে, বাজার বন্ধ, ভয় ও আতঙ্কে ঢাকা।


২০০৭ সালের জানুয়ারি—ঘোষিত হলো জরুরি অবস্থা। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলো। তাদের লক্ষ্য ছিল—“শুদ্ধি অভিযান” ও রাজনৈতিক সংস্কার। দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনই কারাগারে গেলেন। এক পর্যায়ে সংস্কারের নামে দল ভাঙার চেষ্টা চলল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থায়ী কিছু ঘটল না।


২০০৮-এর নির্বাচন ও নতুন সূচনা


দুই বছরের অস্থির সময় শেষে,  ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এ অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। জনগণ তখন স্থিতিশীলতা চেয়েছিল, চেয়েছিল নতুন দিশা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করল।








উপসংহার


১৯৯১ থেকে ২০০৮—এই সময়কাল আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রার এক ভঙ্গুর অধ্যায়। এখানে ছিল আশার দীপ্তি, আবার ভাঙনের বেদনা। জনগণ দেখেছে শাসকের প্রতিশ্রুতি, আবার দেখেছে ব্যর্থতা। তবু এই সময়টিই প্রমাণ করেছে—বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য আপোষহীন। যতই বিভক্তি, ষড়যন্ত্র বা অস্থিরতা আসুক, শেষ পর্যন্ত ভোটের মাধ্যমে তারা তাদের ইচ্ছাই প্রতিষ্ঠা করে।






Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প