পঞ্চম পর্ব: স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ



সংসদে ভাষণ দানরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭২


রাষ্ট্রগঠন ও সংবিধান


১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন  রাষ্ট্রের জন্ম হলো—বাংলাদেশ। কিন্তু  বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসলো  হাজারো জটিল প্রশ্ন। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের   রাষ্ট্রের কাঠামো কেমন হবে ? কেমন হবে প্রশাসন, অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা? কীভাবে পুনর্বাসন করা হবে এক কোটি শরণার্থী ও অগণিত যুদ্ধাহত মানুষকে?


জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে এই বিশাল চ্যালেঞ্জের দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন—রাষ্ট্রকে দাঁড় করাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন একটি  সংবিধান, যেখানে স্বাধীনতার চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকবে।


১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে গঠিত হলো সংবিধান প্রণয়ন কমিটি। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে মাত্র ১১ মাসের মধ্যেই প্রণীত হলো বাংলাদেশের সংবিধান। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে গৃহীত  হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয় ।এই সংবিধানকে আজও গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীলতার অন্যতম সেরা দলিল যা ম্যাগনাকার্টা নামে  গণ্য করা হয়।


জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—ছিল চার মূলনীতি ।  এগুলো মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা বাস্তব সত্যকে ধারণ করেছিল। সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলেও একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।


তবে সংবিধান প্রণয়ন যত সহজ মনে হয়েছিল, বাস্তবে তা কার্যকর করা তত সহজ ছিল না। প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব, ধ্বংসস্তূপে পরিণত অর্থনীতি এবং যুদ্ধোত্তর বিশৃঙ্খলা রাষ্ট্রকে বারবার বিপর্যস্ত করে তুলেছিল।



মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সংকট ও পুনর্গঠন


                  
                রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 



বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কার অর্থনীতি ছিল শূন্যের কোঠায়। কৃষিক্ষেত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত, শিল্পকারখানা অকেজো, নদী-বন্দর অচল, ব্যাংক ও বাণিজ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়া। একদিকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, অন্যদিকে বিধবা নারী ও এতিম শিশুদের দায়িত্ব—সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের কাঁধে এসে জমা হলো অগণিত ভার।


বঙ্গবন্ধু সরকার প্রথম থেকেই পুনর্গঠন কার্যক্রম হাতে নিলেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পনীতি, ভূমি সংস্কার—এসব পদক্ষেপ ছিল মানুষের জীবনযাত্রা ফের স্বাভাবিক করার প্রয়াস। কিন্তু দুর্বল প্রশাসন, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি এবং দক্ষ মানবসম্পদের অভাবের কারণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছিল না।


তারপরও আশার আলো ছিল—মানুষ বিশ্বাস করত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ একদিন ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু সেই বিশ্বাসে আঘাত হানল ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ।



১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ: কারণ ও প্রভান



                                  ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ                                       


১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। প্রায় ১৫ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এই দুর্ভিক্ষে। প্রশ্ন জাগে—এমন দুর্যোগ কেন ঘটল?


প্রথমত, ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ধান উৎপাদন কমে যায় এবং খাদ্য আমদানিতে বিলম্ব ঘটে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম হঠাৎ বেড়ে যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে বাংলাদেশ যথাসময়ে আমদানি করতে পারেনি।


তৃতীয়ত, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতি পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। মজুতদার ও কালোবাজারিরা সংকটকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিও ভূমিকা রেখেছিল—তৎকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সাহায্য দিতে অনীহা দেখায়।


ফলাফল ছিল বিভীষিকাময়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষ না খেয়ে মরতে থাকে, শহর ও গ্রামে ভেসে আসে কঙ্কালসার দেহ। এই দুর্ভিক্ষ সরকারকে জনগণের আস্থা হারাতে বাধ্য করে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।



বাকশাল: উদ্দেশ্য ও বিতর্ক


দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী পরিস্থিতি ও ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একদলীয় ব্যবস্থা “বাকশাল” চালু করেন। এর পূর্ণরূপ ছিল—বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ।


বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রকে একটি কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের অধীনে এনে দ্রুত উন্নয়ন ঘটানো, দুর্নীতি দমন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কমিটি গঠন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং দলীয় শৃঙ্খলার মাধ্যমে তিনি একধরনের “শৃঙ্খলাবদ্ধ গণতন্ত্র” কায়েম করতে চেয়েছিলেন।


কিন্তু বাস্তবে এই ব্যবস্থা সাধারণ জনগণের কাছে স্বাধীনতার চেতনার বিপরীত মনে হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি গণতন্ত্র ও স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য লড়েছিল; অথচ বাকশাল কার্যত বহুদলীয় রাজনীতিকে বন্ধ করে দিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত হলো, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ হলো। ফলে জনমনে চরম বিরক্তি ও ক্ষোভ জন্ম নিল।



বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সামরিক শাসন


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এই দিনটি শুধু একটি পরিবারের হত্যাকাণ্ড নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার অভিযোগ, দুর্ভিক্ষের ক্ষত, বাকশাল নিয়ে অসন্তোষ—সবকিছু মিলে ষড়যন্ত্রকারীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।


এরপর দেশ প্রবেশ করে সামরিক শাসন,ক্যু পাল্টা ক্যুর ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়। খন্দকার মোশতাক আহমেদ অল্প সময় ক্ষমতায় ছিলেন। পরে সিপাহী বিপ্লবের নামে সেনাবাহিনীর প্রভাবে আবির্ভূত হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।



জিয়াউর রহমান: গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও সীমাবদ্ধতা


জিয়াউর রহমান প্রথমে সেনাশাসক হিসেবে আবির্ভূত হলেও পরবর্তীতে তিনি নিজেকে বৈধতা দিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল  (বিএনপি) নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। অনেকে মনে করেন  এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে  তিনি গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছেন।১৯৭৫ সালের জানুয়ারি বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে  দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না, রাজনৈতিক দলের উপর বিধি নিষেধ ছিল, তিনি  সেই বিধি নিষেধ তুলে দিয়ে  সকল দল এবং মতের মানুষকে রাজনীতিতে  অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার  জন্য সকল পত্রিকার উপর থেকে বেশি বিধি নিষেধ তুলে নেন।এজন্য তাকে বহু দলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে বলা হয়। 


 সমালোচকের মতে, তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে  স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি  এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদেরকে  বিচারের মুখোমুখি করার পরিবর্তে  নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা এবং রাজনীতিতে অবাধ প্রবেশাধিকার দেন।


তাঁর শাসনামলে সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। চার মূলনীতির একটি—ধর্মনিরপেক্ষতা—বাতিল করা হয় এবং এর স্থলে “আল্লাহ পাকের উপর পরম বিশ্বাস ও আস্থা” সংযোজন করা হয়। সমাজতন্ত্রের জায়গায় সামাজিক সাম্য ওনায় বিচার এই অর্থে  বাজার মুখে অর্থনীতি এবং ব্যক্তি মালিকানার  স্বীকৃতি  দিয়ে সমাজতন্ত্রের সংজ্ঞা পুনঃ নির্ধারণ করা হয়। 


অর্থনীতিতে  বেশ গতিশীলতা আনয়ন করেন, বিশেষ করে  তার সময়ে মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতি নতুন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়  এবং তখন বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে  বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী  কাজের সুযোগ পায়  যা বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণের ক্ষেত্রে নতুন এক মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতি সহ  পূর্ব এশিয়া কূটনীতি  এবং পশ্চিমা বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক  একটা নিবিড় পর্যায়ে তিনি নিয়ে আসেন। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের  সংগঠন আরব লীগ এবং ওআইসি তে তার  সক্রিয় এবং নেতৃস্থানীয় ভূমিকা  আজও প্রশংসার দাবিদার। তিনি ইরাক এবং ইরান যুদ্ধের মধ্যস্থতার মাধ্যমে  মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব পরিণত হন। 

 

রাজনৈতিক  প্রজ্ঞার পাশাপাশি সামাজিক ক্ষেত্রে ও তার দূরদর্শিতার ছাপ  সুস্পষ্ট। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে যেরকম নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন  ঠিক তেমনি  সামাজিক ক্ষেত্রে গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিমিত্তে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য তিনি গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন, খাল খনন  কর্মসূচি সহ তার ৩১ দফা এখনো বিএনপির  অন্যতম মূল রাজনৈতিক  ও সামাজিক কর্মসূচি। তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, সততা এবং  ন্যায় নিষ্ঠা  বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। যে কারণে তার দল বিএনপি এবং তিনি আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অনেক সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু তিনিই একমাত্র  শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ যিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততার  প্রতিমূর্তি হিসেবে এখনো মানুষের মানসপটে ভাস্বর হয়ে আছেন। 

১৯৮১ সালে চট্টগ্রামে একদল  সেনাবাহিনীর হাতে  জিয়াউর রহমান নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর দেশ আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে।মানুষ যে মৃত্যুর পরেও পরম  জনপ্রিয়তার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হতে পারে তার প্রমাণ ছিল তার মৃত্যুর পরবর্তী জানাযা যেটা এখনো বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় জমায়েত হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি আজও অবিনশ্বর। মানুষ আজও তাকে শ্রদ্ধা ভালবাসা এবং হৃদয়ের গহীনে লালন করে। 



এরশাদ আমল ও সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতা


জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।  বিএনপি মনোনীত বিচারপতি আব্দুস সাত্তার কে হটিয়ে  ১৯৮২ সালে তিনি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে  প্রায় এক দশক তিনি রাষ্ট্র শাসন করেন। তাঁর সময়ে কিছু উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ হলেও দুই দুইটি ভোটারবিহীন নির্বাচন,ভোট জালিয়াতি,ভোটকাট চুরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রেকর্ড সূচিত হয়। কিন্তু    তার শাসনামলে  স্থানীয় সরকারের অন্যতম স্তম্ভ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন  অনুষ্ঠিত হয়, উপজেলায়  নিম্ন আদালত বসে যা  প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিচার পাওয়ার অধিকার কে  সহজ করে। জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন করে  দেশীয় ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে  বিদেশে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করে  যা বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এছাড়াও  আগে কলেরা রোগে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ  আক্রান্ত হতো যা মহামারীর পর্যায়ে ছিল কিন্তু  ডায়রিয়া রোগের জন্য  সহজ পদ্ধতিতে অর্থাৎ ঘরোয়া পদ্ধতিতে  খাবার স্যালাইন উৎপাদনের কৌশল শিখিয়ে  কলেরার হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। বিশেষ বিশেষ রোগের বিরুদ্ধে টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতার পর্যায়ে নিয়ে এসে দেশকে  স্বাস্থ্য সেবায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এরশাদ  সরকারের অন্যতম সফলতা হচ্ছে  গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প যা  ভূমিহীন এবং ছিন্নমূল মানুষদের স্থলে পরিণত হয়। কৃষকদের জন্য  এরশাদ সরকারের অন্যতম প্রকল্প ছিল ঋণ শালিশি বোর্ড স্থাপন, যেখানে প্রান্তিক  চাষী ঋণের দায়ে জর্জরিত  হয়ে বন্ধকী সম্পত্তি  ফিরে পাওয়ার  মহতি প্রকল্প  শুরু করেন।


 সামরিক শাসনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করা ছাড়াও তার অন্যতম  খামখেয়ালী তথা গণবিরোধী  সিদ্ধান্ত ছিল মাধ্যমিক স্তরে এমসিকিউ পদ্ধতির প্রচলন যেখানে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা   প্রশ্ন ব্যাংক  পড়ে পরীক্ষায় গণহারে পাস করার  দিকে ঝুকে পড়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীলতা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। তাছাড়া কার মন্ত্রিপরিষদের সীমাহীন দুর্নীতি এবং  স্বজন প্রীতি ছিল লোকও মুখে মুখে। 


জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার কারণে, বেকারত্ব চরমভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সন্তোষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে,, বিরোধী দলগুলোর লাগাতর আন্দোলনের ও ছাত্র  জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে  ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন ঘটে এবং বাংলাদেশ পুনরায় গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবেশ করে।



উপসংহার

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাথমিক সময় ছিল এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। সংবিধান প্রণয়ন বাঙালির আদর্শকে লিপিবদ্ধ করলেও বাস্তবতার ঘূর্ণিতে তা অনেকবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।


শেখ মুজিবের সময় ছিল স্বপ্ন ও সংকটের মিলনমঞ্চ—একদিকে রাষ্ট্রগঠন ও সংবিধান, অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ ও বাকশাল বিতর্ক। জিয়াউর রহমানের সময় এসেছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি, কিন্তু সামরিক শাসনের ছায়া তাকে পূর্ণতা দেয়নি।


অতএব, স্বাধীনতার প্রথম দুই দশক আমাদের শেখায়—রাষ্ট্র শুধু জয়লাভে প্রতিষ্ঠিত হয় না; তাকে টিকিয়ে রাখতে লাগে দূরদর্শিতা, দক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশ আজ যে পথ অতিক্রম করছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপের শিকড় লুকিয়ে আছে সেই  স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সাফল্য ও ব্যর্থতার ভেতরেই।


Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প