চতুর্থ পর্ব: স্বাধীনতা আন্দোলন





জনসভায় ভাষণ দানরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 


ভূমিকা

বাংলার ইতিহাস যেন বহতা নদীর স্রোতের মতো—কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল, আবার কখনো ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে ওঠা নতুন দিগন্তের মতো। এই ভূখণ্ডের মানুষ বারবার বঞ্চিত হয়েছে, শোষিত হয়েছে, আর সেই বঞ্চনা থেকেই তাদের ভেতরে জন্ম নিয়েছে এক অগ্নিশিখা—স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের  সংগ্রাম, অধিকার আদায়ের লড়াই, আর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণের অবিচল অগ্রযাত্রা।



১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ ও আন্দোলন: বিভক্তির আগুনে ঐক্যের জন্ম


১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর, লর্ড কার্জন বাংলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করার ঘোষণা দেন—পূর্ববঙ্গ ও আসাম একটি প্রদেশ, আর পশ্চিমবঙ্গ আলাদা প্রদেশ। মুখে বলা হয়েছিল প্রশাসনিক সুবিধার জন্য, কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন—বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা দমন করা।


কিন্তু ব্রিটিশরা ভেবেছিল এক, হয়েছে আরেক। বিভক্ত বাংলার মাটিতে আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠল। কলকাতার রাস্তায়, ঢাকা ও চট্টগ্রামের আড্ডায়, মফস্বলের চায়ের দোকানে—সর্বত্র উচ্চারিত হতে লাগল প্রতিবাদের ঝড় । ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এর ডাক দিলেন বাংলার তরুণেরা। বিদেশি কাপড় পোড়ানো হলো, দেশীয় শিল্পে জোর দেওয়া হলো। গান্ধার সুরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন—

“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”

এই গান হয়ে উঠল একসময় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।


বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলাকে নতুন রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত করল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুবক থেকে কৃষক-শ্রমিক পর্যন্ত সবাই বুঝল—একত্রিত না হলে কোনো অধিকারই আদায় করা  যাবে  না। ব্রিটিশরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করল, কিন্তু আন্দোলনের আগুন তখন  দাবানলের মত সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে স্থায়ীভাবে প্রজ্জ্বলিত হয়ে গেছে।


ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮–১৯৫২): রক্তের বিনিময়ে ভাষার অধিকার


১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলো। পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) তখন ছিল জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতায় উপেক্ষিত। সেই নতুন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী ঘোষণা দিল “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।”


কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষ জানত—তাদের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা ভাষা। ঢাকার রাস্তায় ছাত্ররা প্রতিবাদ, বিক্ষোভ  পালন করে।  ১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন, যার চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে।


১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি—বাঙালি জাতির জীবনে এক মাইলফলক। পুলিশি নিষেধাজ্ঞা ভেঙে  তথা ঢাকার রাস্তায় ১৪৪ ধারা ভেঙে  রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অসংখ্য ছাত্র রাজপথে নামে। গুলি চালানো হয় নিরস্ত্র মিছিলে। রক্ত ঝরে, কিন্তু সেই রক্ত থেকেই জন্ম নেয় এক অনন্ত সত্ “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?”


এই আন্দোলন শুধু ভাষার অধিকারই দেয়নি, বাঙালি জাতিকে দিয়েছে এক অভিন্ন চেতনা—নিজের পরিচয়ের জন্য প্রাণ দিতেও পিছপা হবে না। একুশের বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয়েছিল স্বাধীনতার বটবৃক্ষ।পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন জাতি খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, একমাত্র বাংলা ভাষাভাষী জনগণ তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিযে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার আসলে অধিষ্ঠিত করেছে। 



১৯৫৪ নির্বাচন: জনমতের জোয়ার


ভাষা আন্দোলনের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি জনমনে আস্থা ভেঙে পড়ে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে একটি জোট গঠিত হয়, যার অন্যতম নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক, এবং তরুণ নেতৃবৃন্দের মধ্যে উদীয়মান শেখ মুজিবুর রহমান

এই নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে , আর যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে বিপুল ভোটে । নির্বাচনী ইশতেহারে তারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি, কৃষকের অধিকার রক্ষা,  ভূমি সংস্কারসহ বহু দাবি তুলে ধরে। এটি ছিল বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার এক বিরাট বিজয়।


যদিও কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্র করে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি, কিন্তু এই নির্বাচন প্রমাণ করে দিয়েছিল, পূর্ব বাংলার মানুষ শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ,। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যাবে না। 



ছয় দফা আন্দোলন: স্বাধীনতার রূপরেখা


১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থাপন করেন ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা দাবি’। এগুলো ছিল কার্যত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া।

ছয় দফার মূল বিষয় ছিল—

1. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ।

2. কর ও রাজস্বের নিয়ন্ত্রণ।

3. বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষমতা।

4. বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণ।

5. আঞ্চলিক সরকারের হাতে শিল্পায়নের ক্ষমতা।

6. সামরিক ও বাণিজ্যিক নীতিতে পূর্ব বাংলার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।

এই ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবি, যা পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়।


১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এই আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলে। লৌহ মানব আইয়ুব খান পতন ঘটে, কিন্তু বাঙালির দাবি আর ঠেকানো গেল না।



১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা




                          
                             বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ 



১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ও পশ্চিম পাকিস্তানি  রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টু সহ অভিজাতরা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ঘোষণা করল—

“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”


এরপর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ঢাকায় গণহত্যা চালায়। শহীদ হন হাজার হাজার মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে বাঙালি জাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে—এই দেশ স্বাধীন হবেই।


১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গ্রাম-গঞ্জ-নগর বীরত্বে ভরে ওঠে। কৃষক তার হাল ছেড়ে হাতে নেয় অস্ত্র, ছাত্র যোগ দেয় মুক্তিযোদ্ধে  নারী হয়ে ওঠে সংগ্রামী সহযোদ্ধা।


মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিন ছিল বেদনা, ক্ষতি আর প্রত্যাশায়  ভরপুর । অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।




মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত  শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের  কঙ্কাল, ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র 



উপসংহার


১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—এই যাত্রা ছিল বাঙালির আত্মপরিচয়ের, অধিকার রক্ষার, এবং স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার ইতিহাস। প্রতিটি সংগ্রামে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, প্রতিটি ত্যাগ স্বাধীনতার ভিত্তি রচনা করেছে। আজকের বাংলাদেশ সেই দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তস্নাত স্মৃতির প্রতিফলন ।









Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প