তৃতীয় পর্ব: ঔপনিবেশিক শাসনকাল
বাংলার ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসনকাল এক দীর্ঘ দুঃখ-দুর্দশায় গাঁথা, আবার একই সঙ্গে নতুন বোধোদয়ের সূচনা। বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর আগমন যেমন এ ভূখণ্ডের লোকজন কে শোষণ ও দমননীতির শিকার হতে হয়েছিল, তেমনি তাদের উপস্থিতি শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজসংস্কার ও রাজনৈতিক চেতনায় নতুন অধ্যায়ও উন্মোচিত করেছিল। এখানে আমরা বাংলার মানুষ কেমন করে পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি ও সর্বশেষ ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা শোষিত হয়েছিল য়েছিল ,কেমন করে তারা অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে নেমেছিল এবং কেমন করে এইসব ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে বাংলায় আধুনিক চিন্তার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল তার বিশদ বিবরণ রযেছে।
বিদেশি আগমন ও বাণিজ্যের সূত্রপাত
১৬শ শতাব্দীর দিকে বঙ্গোপসাগরের নীল জলপথে ঘরে বাংলায় আগমন ঘটে নতুন অতিথির। আরব, চীন ও মধ্য এশিয়ার বণিকেরা বহু আগেই বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য করলেও, এই সময়ে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর আগমন বাংলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটায় । প্রথমে আসে পর্তুগিজরা। তারা চট্টগ্রাম, হুগলি ও ষাটগাঁও বন্দরকে কেন্দ্র করে মসলা, তুলা, চামড়া, চাল ও নীল রপ্তানি করত। যদিও তারা প্রথমে বাণিজ্যের ছুতোয় এখানে প্রবেশ করেছিল, কিন্তু শীঘ্রই তারা লুণ্ঠন ও দস্যুবৃত্তির মাধ্যমে তাদের আসল পরিচয় প্রকাশ করে। চট্টগ্রামের উপকূল ও সুন্দরবনের খাঁড়িগুলোতে তারা জলদস্যুর মতো আচরণ করত, যা বাংলার সাধারণ মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে।
এরপর আসে ডাচরা, যারা প্রধানত হুগলি ও চন্দননগরে কারখানা স্থাপন করে। তারা তুলনামূলকভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ হলেও মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যিক লাভ। ফরাসিরা চন্দননগরে তাদের ব্যবসার কেন্দ্র গড়ে তোলে, আর আর্মেনীয় বণিকেরা ঢাকায় ব্যবসা বিস্তার করে। কিন্তু এসব বিদেশি শক্তির প্রভাব বাংলার গ্রামীণ জীবনে তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করেনি, যতটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে বা বাংলার ইতিহাস বদলে দেয়ার আমল পরিবর্তন ঘটেছে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে।
ইংরেজ শাসনের উত্থান
![]() |
পলাশের প্রান্তরে ইংরেজদের বিজয়ের পরে লর্ড ক্লাইভ এবং মীর জাফর আলী খান |
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ ছিল বাংলার ভাগ্য নির্ধারণের মোড়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় শুধু এক তরুণ শাসকের পতনই নয়, বরং বাংলার স্বাধীনতার সমাপ্তি এবং ঔপনিবেশিক দাসত্বের সূচনা। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে ব্যবসায়ী রূপে এসেছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বাংলার সম্পদ দখলে নেয় এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করে।
১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার রাজস্ব আদায়ের পূর্ণ অধিকার পায়। এর ফলে বাংলার কৃষক ও সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসে সীমাহীন বর্বরোচিত অত্যাচার ও নির্যাতন। জমিদাররা কোম্পানির হয়ে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করত। কৃষকদের জীবনে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, অনাহার ও ঋণের বোঝা। ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায় । বাংলার উর্বর মাটি থেকে যে ধন-সম্পদ জন্ম নিত, তা লুট হয়ে ইংল্যান্ডে চলে যেত।
নীলচাষ ও কৃষকের কান্না
ঔপনিবেশিক শাসনের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় ছিল নীলচাষ। ইংরেজ বণিকরা কৃষকদের জোর করে নীলচাষে বাধ্য করত। নীল চাষে কৃষকের জমির উর্বরতা নষ্ট হতো, অথচ এর লাভের সিংহভাগ যেত ইউরোপীয় দালাল ও কোম্পানির পকেটে। কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পেত না, ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ত এবং বাধ্য হয়ে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়ত।
১৮৫৯–৬০ সালে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে নীলবিদ্রোহ। কৃষকরা একজোট হয়ে নীলচাষের বিরুদ্ধে লড়াই করে। যদিও ইংরেজরা নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমন করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারকে নীলচাষ কিছুটা সীমিত করতে বাধ্য হতে হয়। এই আন্দোলন বাংলার কৃষক চেতনার জাগরণের প্রতীক হয়ে ওঠে।
ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন
ইংরেজ শাসনের শুরুর দিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহ ছিল ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন। ফকির ও সন্ন্যাসীরা শুধু ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই আন্দোলন ইংরেজদের অস্থির করে তোলে। কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা, অতিরিক্ত খাজনা ও দুর্ভিক্ষ তাদের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছিল।
যদিও ইংরেজরা কঠোর দমননীতি গ্রহণ করে এই আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়, তবুও এর মাধ্যমে বাংলার মানুষ বুঝতে পারে যে, শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধই একমাত্র পথ।
![]() |
সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় |
শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার
শোষণ, নিপীড়ন আর বঞ্চনার মাঝেও ঔপনিবেশিক শাসন বাংলার সমাজে এক নতুন আলোর দ্বার খুলে দেয়,বাংলায় আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটায়। ইংরেজরা প্রথমে নিজেদের স্বার্থে প্রশাসনিক কর্মচারী তৈরির জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করলেও, পরবর্তীকালে এর সুফল বাংলার বুদ্ধিজীবীরা কাজে লাগান। কলকাতা হয়ে ওঠে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রাণ কেন্দ্র।
রাজা রামমোহন রায় আধুনিক শিক্ষার প্রবক্তা হিসেবে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সতীদাহ প্রথা বিলোপে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেয়েদের শিক্ষার প্রসার ও বিধবা বিবাহ প্রচলনের মতো সাহসী উদ্যোগ নেন। এই সংস্কারকগণ শুধু সমাজের কুসংস্কার ভাঙেননি, বরং বাংলার মানুষকে যুক্তি, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদের পথে পরিচালিত করেন ।
রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ
ঔপনিবেশিক শাসনের অবিচার মানুষের মনে রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দেয়। উনিশ শতকের শেষ ভাগে বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ তীব্র রূপ নেয়। ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীরা স্বদেশি আন্দোলনে অংশ নেন। দেশীয় শিল্পের প্রসার, বিদেশি পণ্য বর্জন, দেশপ্রেমের গান, সবকিছু মিলিয়ে বাংলার আকাশে স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়ের আভাস দেখা দেয়।
ব্রিটিশদের শাসন নিঃসন্দেহে শোষণমূলক ছিল, তবে এর বিরুদ্ধেই জেগে ওঠে নতুন এক বাঙালি সত্তা।, যে সত্তা শিক্ষিত, যুক্তিবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং সর্বোপরি স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা।
উপসংহার
ঔপনিবেশিক শাসনকাল বাংলার ইতিহাসে এক দ্বৈত অভিজ্ঞতা রেখে গেছে। একদিকে শোষণ, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য ও অন্যায়,অবিচার , অন্যদিকে শিক্ষার আলো, সমাজ সংস্কার, রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ। বাংলার কৃষক নীলবিদ্রোহে যেমন রক্ত দিয়েছে, ফকির-সন্ন্যাসীরা যেমন প্রাণ বিসর্জন করেছে, তেমনি বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ এই ঋণাত্মক পরিস্থিতির ভেতর থেকেও বাঙালি জাতিকে নতুন দিশা দিয়েছেন।
ঔপনিবেশিক শাসন বাংলার বুক থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নিলেও, এর বিরুদ্ধেই জন্ম নিল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদের রূপ নিল, যার পরিণতি হলো ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
Comments
Post a Comment