প্রথম পর্ব: বাংলাদেশের পরিচিতি

 মানচিত্রে  বাংলাদেশ


বাংলাদেশের নামকরণ ও জন্ম


বাংলাদেশ—এই নামটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক ইতিহাস, এক সংগ্রাম এবং এক আত্মপরিচয়ের ঘোষণা। “বাংলা” শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা মত। কেউ বলেন, এটি এসেছে প্রাচীন ‘বঙ্গ’ শব্দ থেকে; আবার কেউ মনে করেন ‘বঙ্গাল’ শব্দ থেকেই এর সূত্রপাত। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এই ভূখণ্ড একাধিক নামে পরিচিত ছিল—বঙ্গ, গৌড়, সুবর্ণগ্রাম, বঙ্গাল কিংবা পূর্ববঙ্গ। প্রতিটি নামই একটি বিশেষ সময়, বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং সংস্কৃতির প্রতিফলন বহন করে।


তবে দীর্ঘকালীন ঐতিহাসিক পথচলা শেষে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষার পর জন্ম নেয় স্বাধীন রাষ্ট্র—বাংলাদেশ। এই নামটি আর শুধু একটি ভৌগোলিক পরিচয় নয়; এটি মুক্তির অঙ্গীকার, আত্মত্যাগের ফসল এবং ইতিহাসের রক্তাক্ত অথচ গৌরবময় এক অধ্যায়।


বাংলাদেশের জন্ম সহজ কোনো ইতিহাস নয়। ভাষা আন্দোলনের রক্ত, রাজনৈতিক সংগ্রাম, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অদম্য সাহস—সবকিছু মিলেই এই রাষ্ট্রের জন্মভূমি তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক দমননীতি বাংলার মানুষের অন্তরে জমে থাকা বিক্ষোভকে জাগিয়ে তোলে। সেই বিক্ষোভ ধীরে ধীরে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় রূপ নেয়, আর শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তা বিস্ফোরিত হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে নতুন রাষ্ট্র—বাংলাদেশ।


অতএব, বাংলাদেশের নামকরণ কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি এক জাতির আত্মপরিচয়ের স্থায়ী ঘোষণা।


ভৌগোলিক অবস্থান, ভূমিরূপ ও নদীনির্ভর জীবন


দক্ষিণ এশিয়ার হৃদয়ে, ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্ব প্রান্তে গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র–মেঘনা অববাহিকার বুকে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিকভাবে এটি অবস্থিত ২০°৩৪´ থেকে ২৬°৩৮´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°০১´ থেকে ৯২°৪১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। পূর্বে মায়ানমার, পশ্চিম ও উত্তরে ভারত, আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর—এভাবেই বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির আঁকড়ে রাখা এক সবুজ শ্যামল ভূমি।


বাংলাদেশের আয়তন প্রায় ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার, কিন্তু এই ছোট্ট ভূখণ্ডেই বাস করে ১৭ কোটিরও বেশি মানুষ। ভূপ্রকৃতির দিক থেকে দেশটি প্রধানত সমতল ভূমি হলেও উত্তর-পূর্বে সিলেটের চা-বাগানবেষ্টিত টিলা ও দক্ষিণ-পূর্বে চট্টগ্রাম-বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চল বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতিকে বৈচিত্র্য দিয়েছে।


বাংলাদেশকে প্রায়শই বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র—এসব বৃহৎ নদী শুধু ভূমিকে উর্বর করে তুলেনি, বরং মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিকে গড়ে তুলেছে। কৃষিজমিতে প্রতি বছর নদীর পলি এসে মাটিকে উর্বর করে, আবার নদীর ভাঙন বহু মানুষের ঘরবাড়ি কেড়ে নেয়। এভাবেই নদী এখানে একদিকে জীবনের দাতা, অন্যদিকে বেদনার উৎস।


গ্রামীণ অর্থনীতি, পরিবহন, মাছ ধরা, এমনকি লোকসংগীতের ধারা—সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নদীর গভীর সম্পর্ক। ভাটিয়ালি গান, নৌকা বাইচ কিংবা মৎস্যজীবীর জীবনগাথা এই নদীনির্ভর সভ্যতার বহিঃপ্রকাশ।


জলবায়ু ও প্রাকৃতিক সম্পদ






বাংলাদেশের জলবায়ু মৌসুমি প্রভাবাধীন। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড তাপদাহ, বর্ষাকালে আকাশভরা মেঘ আর অঝোর বৃষ্টি, শীতকালে কুয়াশা—এমনই বৈচিত্র্যময় ঋতুচক্র। ছয় ঋতুর দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও আজকের বাস্তবতায় মূলত তিনটি মৌসুম স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়—গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত।


বর্ষা বাংলাদেশের প্রাণ। নদীর জল, মাঠের উর্বরতা এবং কৃষকের জীবন বর্ষার ওপর নির্ভরশীল। তবে অতিবৃষ্টি ও বন্যা অনেক সময় ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনে। অন্যদিকে শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক ও শীতল, যা কৃষি উৎপাদনে ভারসাম্য আনে।


প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ সমৃদ্ধশালী। উর্বর মাটি ও প্রাকৃতিক পানি সম্পদ এ দেশের কৃষির মূল ভিত্তি। ধান, পাট, গম, আলু, চা, আখসহ বিভিন্ন ফসল এখানে জন্মে। এছাড়া সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন কেবল কাঠ ও মধুর উৎস নয়, এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাবর্ম। এখানেই বাস করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণসহ অজস্র প্রাণী।


বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর ও বালুমাটি। বিশেষত প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গৃহস্থালি ব্যবহারের অন্যতম চালিকাশক্তি। তবে এসব সম্পদ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সঠিক ব্যবহার এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।


জনগোষ্ঠী, ভাষা ও সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত পরিচয়


বাংলাদেশ মূলত বাঙালি জাতির আবাসভূমি। প্রায় ৯৮% মানুষ বাঙালি, আর বাকিরা হলো বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী—চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতাল, হাজং, খাসিয়া ইত্যাদি। এ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী দেশের সংস্কৃতিকে দিয়েছে রঙিন বৈচিত্র্য।


বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এটি বিশ্বের সপ্তম সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা এবং এর রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যধারা—সবই বাংলা ভাষার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।


সংস্কৃতির দিক থেকে বাংলাদেশ প্রাণবন্ত। লোকসংগীত, নাটক, নৃত্য, লোককথা—এসব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির অঙ্গন। বৈশাখের প্রথম দিনে ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন, শরতের দুর্গাপূজা, শীতের পৌষ মেলা কিংবা ঈদ ও রমজান—সব উৎসবই জাতিগত ও ধর্মীয় সীমারেখা পেরিয়ে সামাজিক মিলনমেলায় রূপ নেয়।


খাদ্যসংস্কৃতি বাংলাদেশের মানুষের পরিচয়ের আরেকটি দিক। ভাত, মাছ, ডাল, শাক-সবজি সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য। নদী থেকে পাওয়া নানা রকম মাছ ও গ্রামীণ রান্নার স্বাদ বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়ে উঠছে।


উপসংহার


বাংলাদেশের পরিচিতি আসলে তার নাম, জন্ম, ভৌগোলিক অবস্থান, নদীনির্ভর জীবন, জলবায়ু, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং জনগোষ্ঠীর বহুমুখী বৈশিষ্ট্যের এক বর্ণিল চিত্রপট। এ দেশের ইতিহাস রক্তাক্ত সংগ্রামের, ভূগোল নদীর স্রোতে ভাঙা-গড়ার, আর সংস্কৃতি হলো বাঙালির প্রাণের উৎসব। তাই বাংলাদেশ কেবল একটি রাষ্ট্র নয়; এটি এক আবেগ, এক আত্মপরিচয় এবং এক অনন্ত যাত্রার নাম।



Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প