প্রথম পর্ব : শ্রীলংকা: ভারত মহাসাগরের মুক্তো

 মানচিএে শ্রীলঙ্কা 


ভারত মহাসাগরের নীল জলে ভেসে থাকা শ্রীলংকা এক অপূর্ব দ্বীপদেশ। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও তার ঐতিহাসিক ঐশ্বর্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৌদ্ধ সংস্কৃতির দীপ্তি এবং সমুদ্রতীরবর্তী জনজীবনের রঙিন চিত্র তাকে বিশ্বমঞ্চে এক অনন্য মর্যাদা দিয়েছে। সিংহলীদের ভাষায় এই দ্বীপকে বলা হয় “লঙ্কা”—অর্থাৎ উজ্জ্বল ভূমি। সমুদ্রঘেরা এই দেশটির প্রতিটি ইঞ্চি যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক সোনালি চিত্রকলা।

ভূমিরূপ

শ্রীলংকা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র, যা ভারতবর্ষের দক্ষিণে অবস্থিত। ছোট্ট পক প্রণালী এবং মন্নার উপসাগর দ্বারা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। দ্বীপটির মোট আয়তন প্রায় ৬৫,০০০ বর্গকিলোমিটার।

ভূমিরূপকে মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়—

১. উচ্চভূমি ও পর্বত অঞ্চল: মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত পাহাড় ও মালভূমি। এখানে পাইডুরুতালাগালা (২,৫২৪ মিটার) শ্রীলংকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ।

২. নিম্নভূমি সমভূমি: দ্বীপের চারপাশে বিস্তৃত, উর্বর কৃষিজমি ও নদীবাহিত সমতলভূমি।

৩. সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল: প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা, যেখানে রয়েছে সোনালি বালুর সৈকত, নারিকেল গাছের সারি আর নীলাভ সমুদ্রের ঢেউ।

জলবায়ু

শ্রীলংকার জলবায়ু উষ্ণমণ্ডলীয়। গড় তাপমাত্রা ২৭–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। দেশটিতে দুটি মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়—

দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী (মে–সেপ্টেম্বর),

উত্তর-পূর্ব মৌসুমী (ডিসেম্বর–ফেব্রুয়ারি)।

এর ফলে বছরে দু’বার বৃষ্টিপাত হয়, যা কৃষির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। পাহাড়ি অঞ্চলে আবহাওয়া শীতল ও মনোরম, আর উপকূলে গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ু বিদ্যমান।

জনসংখ্যা

শ্রীলংকার জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ২০ লক্ষ। জনসংখ্যার বেশিরভাগ অংশ গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে, তবে রাজধানী কলম্বো, প্রশাসনিক শহর শ্রী জয়াবর্ধনপুর কোট্টে, এবং পর্যটননগরী ক্যান্ডি ও গল-এ নগরায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ধর্ম

শ্রীলংকা ঐতিহাসিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম কেন্দ্র। প্রায় ৭০% মানুষ বৌদ্ধ। এছাড়া হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম শ্রীলংকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির মেরুদণ্ড, কারণ খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে মহিন্দ নামে এক ভিক্ষুর মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্ম এখানে বিস্তার লাভ করে। দেশজুড়ে অসংখ্য দাগোবা, স্তূপ এবং প্রাচীন মন্দির সেই ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাক্ষী।

আদমস পিক ও রামসেতু—দুই ধর্মীয় ও ভৌগোলিক রহস্য

হযরত আদম (আ.) ও শ্রীলঙ্কার আদমস পিক (Adam’s Peak)

ধর্মীয় বিশ্বাস: অনেক ইসলামি বর্ণনা ও লোকবিশ্বাসে বলা হয়, হযরত আদম (আ.) যখন জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, তখন তাকে শ্রীলঙ্কার ভূমিতেই প্রেরণ করা হয়েছিল। দ্বীপটির মধ্য-দক্ষিণ অংশে একটি সুউচ্চ পর্বত রয়েছে, যাকে আজও “শ্রী পদ” বা আদমস পিক বলা হয়।

অবতরণের স্থান: বিশ্বাস করা হয়, তিনি প্রথমে এই পর্বতের চূড়ায় অবতরণ করেন এবং সেখানেই তার পায়ের ছাপ (Footprint) বর্তমান।

নিদর্শন:

পর্বতের শীর্ষে প্রায় ৫ ফুট লম্বা একটি পায়ের ছাপের মতো চিহ্ন রয়েছে। মুসলমানরা একে হযরত আদম (আ.)-এর পায়ের ছাপ বলে মানেন।

বৌদ্ধরা একে গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ন হিসেবে মানে।

হিন্দুরা বিশ্বাস করেন এটি মহাদেব শিবের পদচিহ্ন।

খ্রিস্টানদের একাংশও একে আদমের পদচিহ্ন হিসেবে সম্মান করে।

সাহিত্যিক গুরুত্ব: শ্রীলঙ্কার এই “আদমস পিক” যেন বহুধর্মের মিলনস্থল—যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম একই নিদর্শনে নিজ নিজ বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখে।

বাস্তবতা: ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে এটি প্রাকৃতিক শিলা গঠন, তবে শত শত বছর ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের কারণে এটি পবিত্র স্থান হিসেবে স্বীকৃত।

 অর্থাৎ, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে হযরত আদম (আ.)-এর এই ধর্মীয় কাহিনী গভীরভাবে জড়িত। মুসলমানরা একে নবী আদম (আ.)-এর অবতরণের স্থান মনে করেন, আর তাই আজও এটি একটি ঐতিহাসিক ও পবিত্র নিদর্শন হিসেবে বিশ্বজোড়া পরিচিত।

রামসেতু বা আদমস ব্রিজ – সাগরের নিচের রহস্যময় পথ

প্রাচীন বিশ্বাস: ভারতীয় উপমহাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মাঝে সমুদ্রের বুক জুড়ে রয়েছে এক অদ্ভুত শিলাময় রেখা, যাকে হিন্দু পুরাণে বলা হয় রামসেতু। মহাকাব্য রামায়ণ-এ উল্লেখ আছে—ভগবান রামের বানরসেনা নাকি শ্রীলঙ্কায় সেতু নির্মাণ করেছিলেন, সীতাকে উদ্ধারের জন্য।

ইসলামী ও পাশ্চাত্য উল্লেখ: মুসলিম ভ্রমণকারীরা এবং ইউরোপীয় মানচিত্রবিদেরা একে দীর্ঘদিন Adam’s Bridge বলে চিহ্নিত করেছেন, ধারণা করা হয়—এটি নাকি হযরত আদম (আ.) পৃথিবীতে অবতীর্ণ হওয়ার পর ভারতীয় উপমহাদেশে যাওয়ার পথের অংশ।

ভৌগোলিক সত্য: আধুনিক স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে—ভারতের তামিলনাড়ুর রামেশ্বরম থেকে শ্রীলঙ্কার মান্নার দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার লম্বা বালু ও প্রবাল দিয়ে তৈরি প্রাকৃতিক বাঁধ রয়েছে। সমুদ্রের নিচে স্পষ্ট রেখার মতো এই সেতু আজও দৃশ্যমান।

চিহ্ন আজও আছে কিনা: হ্যাঁ, আজও নৌযাত্রীরা এবং গবেষকরা এটিকে দেখতে পান। এখনো বড় জাহাজ চলাচল করতে পারে না এই অঞ্চলে, কারণ সেতুর মতো বালুচর সমুদ্রপৃষ্ঠের একদম নিচে উঠে আছে।

সাহিত্যিক ব্যাখ্যা: ভারত মহাসাগরের নীল জলে যেন ঘুমিয়ে আছে এক কিংবদন্তির সেতু—কখনো দেবতার কাহিনিতে, কখনো নবীর স্মৃতিতে, আবার কখনো ইতিহাসের রহস্যে। রামসেতু বা আদমস ব্রিজ তাই শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মাঝে শুধু ভৌগোলিক সংযোগ নয়, বরং বিশ্বাস, কল্পনা আর বাস্তবতার মেলবন্ধন।

 অর্থাৎ, সত্যিই সমুদ্রের নিচে ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার একটি প্রাকৃতিক সেতুর মতো চিহ্ন রয়েছে, যা আজও মানচিত্র ও স্যাটেলাইটে স্পষ্ট দেখা যায়।

জাতি ও গোষ্ঠী

শ্রীলংকার প্রধান জনগোষ্ঠী হলো সিংহলি (প্রায় ৭৫%)। এছাড়াও তামিল জনগোষ্ঠী (উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে বেশি), মুর (মুসলিম), এবং কিছু সংখ্যক বার্গার (ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত) ও মালয় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত দ্বন্দ্ব এই দেশের ইতিহাসে ছায়া ফেলেছে, তবে বহুত্ববাদী ঐতিহ্য এখনো বিদ্যমান।

সাহিত্য, কবি ও সংস্কৃতি

শ্রীলংকা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যে নয়, সাহিত্যেও সমৃদ্ধ।

আনন্দ কুমারস্বামী ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক।

মার্টিন উইকরামাসিংহে তাঁর উপন্যাস ও প্রবন্ধের জন্য বিখ্যাত।

মাইকেল ওনদাতজি, শ্রীলংকান বংশোদ্ভূত আন্তর্জাতিক লেখক, “The English Patient” উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পান।

সংস্কৃতির মূল রঙ বহন করে বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসব, ক্যান্ডিয়ান নৃত্য, প্রাচীন শিল্পকলা, মুখোশনৃত্য এবং রঙিন পোশাক।

জাতীয় সংগীত ও তার রচয়িতা

শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত হলো ”,শ্রীলঙ্কা মাতা"যার অর্থ—“শ্রীলংকা মাতৃভূমি।”এর রচয়িতা কবি আনন্দ সমরকূণ। সংগীতটি স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এতে দেশপ্রেম, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং দ্বীপভূমির সৌন্দর্যের মহিমা গাওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক দল ও ইতিহাস

শ্রীলংকা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রাথমিকভাবে এটি ছিল ডমিনিয়ন রাষ্ট্র, পরে ১৯৭২ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।

বর্তমানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হলো—

শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি (SLFP)

ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (UNP)

শ্রীলংকা পিপলস ফ্রন্ট (SLPP)

তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (TNA)

শ্রীলঙ্কার মাটিতে বিদেশি শক্তির আগমন  এবং লংকাংদের প্রতিরোধ 

সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপ, ভারত মহাসাগরের হৃদয়ে বসে থাকা শ্রীলঙ্কা, তার অবস্থানের কারণেই যুগে যুগে বিদেশি শক্তির লোলুপ দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছে। বন্দর, মসলা, রত্ন—এসবের লোভে অনেক জাতি এখানে এসেছে। কিন্তু প্রতিবারই শ্রীলঙ্কার মানুষ বীরের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, শোষণ ও দমন নস্যাৎ করেছে, আর আন্দোলনের আগুনে নিজেদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করেছে।

১. পর্তুগিজদের আগমন (১৬শ শতক)

তারা মূলত  মসলা ও বাণিজ্যের জন্য, বিশেষ করে দারুচিনির জন্য এখানে আসে ।

 ১৫০৫ সালে প্রথমবার তারা নৌপথে এসে  দ্বীপে অবতরণ করে। উপকূলীয় এলাকায় শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে এবং স্থানীয় রাজ্যগুলিকে দুর্বল করতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কৌশল নেয়।ক্যান্ডি রাজ্য তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এবং পাহাড়ি দুর্গ থেকে পর্তুগিজ বাহিনীকে বারবার পরাস্ত করে।

ফলাে দীর্ঘ সংঘর্ষ শেষে ১৬৫৮ সালে ডাচদের হাতে পর্তুগিজদের পতন হয়।

২. ডাচদের শাসন (১৭শ শতক)

 বাণিজ্যিক আধিপত্যের জন্য—বিশেষত দারুচিনি ও সমুদ্র বাণিজ্য। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্যে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে উপকূলীয় অঞ্চল দখল করে। ক্যান্ডির রাজারা স্বাধীনতা রক্ষা করে চলতে থাকেন। জনগণও ডাচদের দমননীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে।

ফলে ডাচরা স্থানীয়দের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশরা ডাচদের বিতাড়িত করে।

৩. ব্রিটিশ শাসন (১৭৯৬–১৯৪৮)

কৌশলগত দখল, সমুদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ, এবং চা, কফি, রাবারসহ কৃষি-শিল্প বিস্তার।প্রথমে ডাচদের কাছ থেকে উপকূল দখল করে। ১৮১৫ সালে ‘ক্যান্ডি কনভেনশন’-এর মাধ্যমে পুরো দ্বীপ দখল করে নেয়।

ক্যা্ন্ডিয়ান বিদ্রোহ (১৮১৭–১৮): 

স্থানীয় জনগণ ও নেতাদের নেতৃত্বে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়, যদিও নির্মমভাবে দমন করা হয়।

উপকূলীয় প্রতিরোধ: 

কৃষক, শ্রমিক ও সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশদের কর নীতি ও ভূমি দখলের বিরুদ্ধে ছোট ছোট আন্দোলন করে।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (১৯১৯): 

শ্রীলঙ্কা ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন পি. আনন্দ কুমারস্বামী, এ. ই. গুনাসিংহে, দোন সেঞ্চো ফার্নান্দো প্রমুখ।

শ্রমিক আন্দোলন: 

বিশেষ করে তামিল শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে ওঠে।

ফলাফল: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন জোরালো হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কা (তখন সিলন) স্বাধীনতা লাভ করে।

৪. পাকিস্তানি ও ভারতীয় প্রভাব (স্বাধীনতার পর)

যদিও সরাসরি উপনিবেশ নয়, তবে শীতল যুদ্ধের সময় ভারত ও পাকিস্তান শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। বিশেষ করে তামিল সমস্যার সময় ভারতীয় হস্তক্ষেপ বড় ভূমিকা রাখে।

৫. তামিল বিদ্রোহ ও মুক্তি সংগ্রাম (১৯৮৩–২০০৯)

কারা: তামিল টাইগার (LTTE) সংগঠন, ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নেতৃত্বে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র গড়ার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম, আত্মঘাতী হামলা, গেরিলা যুদ্ধ হয়। সরকারী সেনারা, ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী (১৯৮৭–৯০) এবং পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে দমন করা হয়। 

ফলাফল: ২০০৯ সালে সরকারি সেনারা LTTE-কে পরাস্ত করে। শ্রীলঙ্কা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকে, তবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষত এখনো জাতির ইতিহাসে রয়ে গেছে।

এভাবে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কা কখনো পর্তুগিজ, কখনো ডাচ, কখনো ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছে। প্রতিবারই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে—কখনো রাজাদের নেতৃত্বে, কখনো সাধারণ মানুষের বিদ্রোহে, আবার কখনো শ্রমিকদের সংগঠনে। 

স্বাধীনতা সংগ্রাম

শ্রীলংকার স্বাধীনতা আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলেও দৃঢ় ছিল। ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। তবে স্বাধীনতার পরও জাতিগত দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধ বহু বছর ধরে দেশকে ক্ষতবিক্ষত করে। বিশেষত ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চলা গৃহযুদ্ধ শ্রীলংকার ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়। তবুও, দেশটি ধীরে ধীরে পুনর্গঠন ও স্থিতিশীলতার পথে এগোচ্ছে।

অর্থনীতির মূল খাত


শ্রীলঙ্কার  চা বাগান 

শ্রীলংকার অর্থনীতি বহুমুখী—

১. কৃষি: চা, রাবার, নারিকেল, দারুচিনি ও ধান প্রধান ফসল। শ্রীলংকার “সিলন টি” বিশ্ববিখ্যাত।

২. পর্যটন: সমুদ্রতীর, প্রাচীন মন্দির, ক্যান্ডি ও আনুরাধাপুরার ঐতিহাসিক নিদর্শন, আর সিগিরিয়া শিলাদুর্গ পর্যটকদের টানে।

৩. বস্ত্র ও গার্মেন্টস: রপ্তানির অন্যতম প্রধান খাত।

৪. বিদেশি রেমিট্যান্স: মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকরা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান।

৫. মৎস্যসম্পদ: সমুদ্রঘেরা দেশ হওয়ায় মৎস্যশিল্পও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উপসংহার

শ্রীলংকা এক বহুরূপী দ্বীপদেশ—যেখানে সমুদ্রের ঢেউ, পাহাড়ি চা-বাগান, প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপ আর রঙিন উৎসব একসাথে মিশে গেছে। উপনিবেশিক শোষণ, জাতিগত দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধ অতিক্রম করে দেশটি আজ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে। শ্রীলংকা আমাদের শেখায়—একটি দ্বীপও তার সাহস, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও ইতিহাসের শক্তিতে বিশ্বমঞ্চে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে।



Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প