দ্বিতীয় পর্ব : নেপাল: স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ যাত্রা
![]() |
পৃথ্বী নারায়ণ শাহ,নেপালের জাতির জনক |
ভূমিকা – হিমালয়ের বুকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা
হিমালয়ের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা নেপাল শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের মতোই তাদের সংগ্রাম আকাশছোঁয়া, আর গঙ্গা–ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মতোই তাদের বেদনা বহমান। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সংবিধান ও রাষ্ট্রের মর্যাদার জন্য নেপালি জনগণ যে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে, তার প্রতিটি অধ্যায় রক্ত, অশ্রু ও আত্মত্যাগে রঞ্জিত।
নেপাল ছোট দেশ হলেও তার ইতিহাস কোনো ছোট কাহিনী নয়। ভারতের উপমহাদেশে যখন ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব প্রবল, তখনও নেপাল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকে। কিন্তু সেই স্বাধীনতা ছিল প্রজাদের নয়—ছিল রাজা ও রাজতন্ত্রের অধীনে। তাই নেপালের মানুষের প্রকৃত সংগ্রাম ছিল দ্বিমুখী:
১) বাইরের শক্তির আধিপত্য রোধ করা।
২) ভেতরের দমননীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।
পৃথ্বী নারায়ণ শাহ :নেপালের জাতির জনক
তিনি ১১ জানুয়ারি ১৭২৩ সালে, গোরখা রাজ্যে। তাঁর পিতার নাম রাজা নরভূপাল শাহ, মাতার নাম কৌশল্যা বতী।
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী, কৌশলী ও রাষ্ট্রগঠনে আগ্রহী।
নেপাল ঐক্যবদ্ধকরণের ভূমিকা
১৭শ ও ১৮শ শতকের শুরুতে বর্তমান নেপাল অসংখ্য ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল—যেমন কাঠমাণ্ডু, ভক্তপুর, ললিতপুর ইত্যাদি।পৃথ্বী নারায়ণ শাহ এই বিভক্ত রাজ্যগুলোকে একত্রিত করার জন্য সামরিক অভিযান শুরু করেন।দীর্ঘ যুদ্ধ ও কূটনীতির মাধ্যমে তিনি ১৭৬৮ সালে কাঠমাণ্ডু উপত্যকা দখল করে গোরখা রাজ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নেন।পরবর্তীতে অন্যান্য রাজ্যগুলোও যুক্ত হয় এবং নেপাল একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে রূপ নেয়।
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
তিনি নেপালকে “আসিয়া মহাদেশের মধ্যে দুই বৃহৎ শক্তি ভারত ও চীনের মাঝে একটি বাঁশের ঝুড়ির মতো স্বাধীন রাষ্ট্র” বলে বর্ণনা করেছিলেন।তিনি বিদেশি প্রভাব থেকে নেপালকে মুক্ত ও স্বনির্ভর রাখার ওপর জোর দেন।তিনি “Divine Country” হিসেবে নেপালকে দেখতেন এবং সংস্কৃতি, ধর্ম ও ঐতিহ্য রক্ষার কথা বলতেন।
তিনি ১১ জানুয়ারি ১৭৭৫ সালে, নেপালের নুয়াকোটে।
মৃত্যুর আগে তিনি নেপালকে একটি স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
অবদান ও উত্তরাধিকার
1. ঐক্যবদ্ধ নেপাল গঠন –তিনি ১৮শ শতকে ছোট ছোট রাজ্যগুলো একত্রিত করে একটি ঐক্যবদ্ধ নেপাল গঠন করেন এবং এজন্য
2. সাংস্কৃতিক ঐক্য রক্ষা – হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে একত্রিত করে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি বানান।
3. বিদেশি আগ্রাসন প্রতিরোধ – বিশেষ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব থেকে দেশকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন।
4. জাতীয়তাবাদী চিন্তা – তিনি নেপালকে এক জাতি, এক রাষ্ট্র, এক সংস্কৃতির মাধ্যমে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন।
তাই পৃথ্বী নারায়ণ শাহকে নেপালের জনগণ শ্রদ্ধাভরে “জাতির জনক” বলে ডাকে।
প্রাচীন রাজতন্ত্র থেকে আধুনিক রাষ্ট্রগঠন
১৮শ শতাব্দীতে গোরখা রাজা পৃথ্বী নারায়ণ শাহ নেপালের ভিন্ন ভিন্ন উপত্যকা ও রাজ্য একত্র করে আধুনিক নেপালের ভিত্তি স্থাপন করেন। কিন্তু এই ঐক্য আনে রাজতান্ত্রিক শাসনের এক দীর্ঘ ছায়া। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজা, রাজপরিবার এবং অভিজাত শ্রেণি সাধারণ মানুষকে শোষণ করে এসেছে।
১৯শ শতকে ব্রিটিশ শক্তি যখন ভারতবর্ষ দখলে নিয়েছে, তখন নেপাল ব্রিটিশদের সঙ্গে সুকৌশলে সম্পর্ক বজায় রাখে। ১৮১৪–১৮১৬ সালের অ্যাংলো–নেপাল যুদ্ধ শেষে স্বাক্ষরিত সুগৌলি চুক্তি নেপালের ভূখণ্ড ছেঁটে দেয়। এর মাধ্যমে ব্রিটিশরা নেপালের উপর সরাসরি শাসন প্রতিষ্ঠা না করলেও পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে। এই চুক্তি ছিল নেপালের সার্বভৌম মর্যাদার ওপর এক আঘাত, আর এ থেকেই জন্ম নেয় আধিপত্যবিরোধী চেতনা।
স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাহিনী ও গণমানুষের চেতনা
২০শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যখন ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরালো হয়, তখন নেপালের মানুষও অনুপ্রাণিত হতে থাকে। নেপালি কংগ্রেস, বিপ্লবী কবি লক্ষ্মীপ্রসাদ দেবকোটা, বিশিষ্ট নেতা বিষ্ণুপ্রসাদ কৈরালা—এরা সবাই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ভাষা শিখিয়েছেন সাধারণ মানুষকে।
রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি আওয়াজ তোলা সহজ ছিল না। রানা শাসকরা (১৮৪৬–১৯৫১) সেনাবাহিনী ও গোপনচর দিয়ে ভিন্নমত দমন করত। কিন্তু শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখে জেগে উঠেছিল। তারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। অনেক নেপালি যুবক বন্দিত্ব, গুলি, নির্যাতন সত্ত্বেও স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দাবিতে সোচ্চার হয়।
১৯৫১ সালে জনগণের আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রানা শাসনের পতন ঘটে। রাজা ত্রিভুবন ক্ষমতায় ফিরে এসে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বপ্ন তখনও দূরের।
গণতন্ত্রের সূচনা ও বারবার ব্যর্থতা
১৯৫১ সালের পর নেপালে প্রথমবার বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু হয়। তবে এটি ছিল খুবই ভঙ্গুর। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভক্তি, রাজতন্ত্রের প্রভাব এবং ভারতের চাপ—সব মিলিয়ে গণতন্ত্র দাঁড়াতে পারল না।
১৯৬০ সালে রাজা মহেন্দ্র সংসদ ভেঙে দিয়ে "পঞ্চায়েত ব্যবস্থা" চালু করেন। এটি ছিল রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রিত একদলীয় শাসনব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যায়, রাজনৈতিক কর্মীরা জেলে যায় বা নির্বাসনে বাধ্য হয়।
তবুও গণতন্ত্রের দাবিতে প্রতিবাদ থেমে থাকেনি। ১৯৭৯ সালে ছাত্র আন্দোলন দেশ কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৯০ সালে এক বৃহত্তর গণআন্দোলন "জন আন্দোলন" (জন আন্দোলন ১) রাজতন্ত্রকে সংবিধান সংশোধন ও বহুদলীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করে। এভাবেই গণতন্ত্র নেপালে নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়।
সংবিধান প্রণয়নের দীর্ঘ সংগ্রাম ও বিভক্তি
গণতন্ত্র এলেও সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে নেপাল বারবার ব্যর্থ হয়।
১৯৯০ সালের সংবিধান রাজতন্ত্রের ক্ষমতা পুরোপুরি খর্ব করতে পারেনি।
১৯৯৬ সালে মাওবাদীরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। তাদের দাবি ছিল রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
এক দশকব্যাপী এই গৃহযুদ্ধে ১৭,০০০ এর বেশি মানুষ নিহত হয়।
২০০৬ সালে আবারও এক জন আন্দোলন (জন আন্দোলন ২) রাজতন্ত্রকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে। রাজা গ্যানেন্দ্র ক্ষমতা ছেড়ে দেন। ২০০৮ সালে নেপাল ঘোষণা করে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র।
তবে সংবিধান প্রণয়নের কাজ জটিলতায় পড়ে। প্রথম সংবিধান সভা ভেঙে যায়, দ্বিতীয় সভা বসে। জাতিগত, আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক বিভক্তি—সব মিলিয়ে সংবিধান হতে সময় লেগে যায় দীর্ঘ ৭ বছর। অবশেষে ২০১৫ সালে নেপাল একটি নতুন সংবিধান পায়। কিন্তু এও বিতর্কিত; মধেশি ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী এটিকে বৈষম্যমূলক বলে মানতে নারাজ।
ভারতের আধিপত্যবাদ ও নেপালের ভৌগোলিক সংকট
নেপালের ভূগোল তার রাজনৈতিক ভাগ্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। উত্তরে চীন, দক্ষিণে ভারত। সমুদ্রবন্দরহীন নেপাল বাণিজ্য ও জ্বালানি নির্ভরতার কারণে ভারতের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল।
ভারত বহুবার এই নির্ভরতাকে রাজনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার করেছে।
১৯৮৯ সালে সীমান্ত অবরোধ করে নেপালকে চাপে রাখে।
২০১৫ সালে নতুন সংবিধান ঘোষণার পর ভারত আবারও অনানুষ্ঠানিক অবরোধ চালায়। এর ফলে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ সংকট দেখা দেয়।
নেপালি জনগণ এটিকে ভারতের আধিপত্যবাদ হিসেবে দেখে। ফলে নেপাল ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। এশীয় ভূরাজনীতির এই টানাপোড়েন নেপালের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা বনাম বাস্তবতা
নেপালে সরকারের স্থায়িত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।১৯৯০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০টির মতো সরকার পরিবর্তন হয়েছে।জোটভিত্তিক রাজনীতি, পার্টির ভাঙন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব—এসব কারণে স্থিতিশীল নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি।
গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট নয়; গণতন্ত্র মানে জবাবদিহিতা, স্থিতিশীল প্রতিষ্ঠান, সুশাসন। কিন্তু নেপালে এই ভিত্তি শক্ত হয়নি। ফলে জনগণের আস্থা বারবার নষ্ট হয়েছে।
নেপালের মানুষ চেয়েছিল গণতন্ত্র মানে স্বাধীনতা, কর্মসংস্থান, ন্যায়বিচার। কিন্তু তারা পেয়েছে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি ও বৈষম্য।গ্রামে এখনো শিক্ষার হার খুব কম ।কর্মসংস্থানের অভাব প্রবল, লাখো তরুণ বিদেশে শ্রমবাজারে যায় ।সংবিধানে সমঅধিকার থাকলেও বাস্তবে নারী, দলিত ও সংখ্যালঘুরা বৈষম্যের শিকার।
তবুও জনগণ হাল ছেড়ে দেয় নি,। নতুন প্রজন্ম সংগ্রাম করেছে, করছে।
সমসাময়িক নেপালের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ ভাবনা
নেপালের ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা স্পষ্ট:
১. গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, এটি হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক।
২. বাহ্যিক শক্তির প্রভাব কমিয়ে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়তে হবে।
৩. জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গড়া জরুরি।
৪. জনগণের আস্থা অর্জন করতে হলে দুর্নীতি দমন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
নব-প্রজন্মের বিপ্লব: গণতন্ত্রের নতুন দিগন্ত
সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ: ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সরকার ২৬টি বড় সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম (যেমন Facebook, YouTube, WhatsApp, Instagram) অবরোধ করে, যা অনেকেই গণতান্ত্রিক কণ্ঠ বন্ধ করার চেষ্টা বলে বর্ণনা করেন ।
যুব অসন্তোষের উত্থান: এই সিদ্ধান্ত ‘Gen Z Revolution’ নামে পরিচিত একটি যুব-নেতৃত্বাধীন গণ-বিদ্রোহের উসকে দেয় । আন্দোলনের মূলে ছিল—দুর্নীতি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক বিরোধিতা ও নিজস্ব কণ্ঠের অধিকার যুদ্ধ।
ঘটনাবলি ও বিপ্লবীর শক্তি
![]() |
গোর্খা বাহিনীর যুদ্ধাভিযান |
বিক্ষোভ ও সহিংসতা: রাজধানী কাঠমান্ডুতে হাজার হাজার তরুণ বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবন, পার্লামেন্ট, এবং প্রেসিডেন্ট অফিসে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভকে ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলির কারণে কমপক্ষে ১৯–২৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয় ।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ: এই বিপ্লবী ক্ষোভ সরকারের কাঠামোর ভিত্তিকে চাপে ফেলে, ফলে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন ।
তরুণ আন্দোলনের অর্থ ও গুরুত্ব
“এই আমাদের বিপ্লব। এখন আমাদের পালা” — এই স্লোগানে প্রজন্মের নির্ভীক প্রচার গণতন্ত্রের জন্য তরুণদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংগ্রামকে চিত্রিত করে ।
রাজনীতির নতুন মুখ: কাঠমান্ডুর মেয়র, প্রাক্তন র্যাপার ও প্রকৌশলী বলেনদ্র শাহ, এই আন্দোলনে সিম্বল হয়ে ওঠেন—যুব সমাজের কাছে তিনি ‘নতুন নেতৃত্বের প্রতীক’ । তরুণেরা তাঁর নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ অস্থায়ী কর্তৃপক্ষ কায়েমের ডাক দেয়।
“চীন–ভারত প্রতিযোগিতা ও নেপালের দ্বন্দ্বময় অবস্থান”
নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান তাকে কৌশলগতভাবে অনন্য করে তুলেছে। দক্ষিণে ভারতের বিশাল সীমান্ত, উত্তরে চীনের তিব্বত। সমুদ্রবন্দরহীন নেপাল ঐতিহাসিকভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে চীনের বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ছে।
1. ভারতের নির্ভরতা ও অবরোধের রাজনীতি
১৯৮৯ এবং ২০১৫ সালে ভারত সীমান্ত অবরোধ চালায়, যার ফলে নেপাল তীব্র জ্বালানি ও খাদ্য সংকটে পড়ে।
এই অভিজ্ঞতা নেপালি রাজনীতিবিদ ও জনগণকে বিকল্প খোঁজার দিকে ঠেলে দেয়।
2. চীনের প্রভাব বিস্তার
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতায় চীন নেপালে অবকাঠামো ও সড়ক নির্মাণে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।
চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানে ভারতের উপর নির্ভরশীলতা কমানো, তবে একই সঙ্গে চীনের প্রভাব বাড়তে দেওয়া।
3. দুই পরাশক্তির মাঝে নেপালের কূটনৈতিক ভারসাম্য
ভারতের সাথে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর।
চীনের সাথে সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বেড়েছে।
তাই নেপালকে বারবার “দড়ির টানে বাঁধা ঘুড়ি”র মতো অবস্থায় পড়তে হয়।
4. ভূরাজনীতির শিকার সাধারণ মানুষ
ভারতের অবরোধ সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করেছে।
চীনের বিনিয়োগ কর্মসংস্থানের কিছু সুযোগ তৈরি করলেও ঋণের ফাঁদ নিয়ে উদ্বেগ আছে।
জনগণ বুঝতে পারছে—গণতন্ত্র শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং বৈদেশিক শক্তিরও খেলার মাঠ।
নেপালের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা – স্বাধীন কূটনীতির অভাব
নেপাল বরাবরই স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জ্বল এক দেশ। কিন্তু বাস্তবতার আয়নায় তাকালে দেখা যায়—এই পাহাড়ি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো নিজস্ব কূটনীতি ও নীতিতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে না পারা। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নেপাল যেন এক চিরন্তন সেতু—দুই পরাশক্তি ভারত ও চীনের মাঝে ঝুলে থাকা। একদিকে ভারতীয় আধিপত্য, অপরদিকে চীনের আগ্রহ—এই দুই শক্তির দোলাচলের ভেতর নেপাল প্রায়শই নিজের কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলেছে।
নেপালের রাজনীতি তাই বহুবার দেখা গেছে দোদুল্যমান—কখনো দক্ষিণের প্রতিবেশীর কাছে আপস করতে হয়েছে, আবার কখনো উত্তরের শক্তিধর বন্ধুর ছায়ায় আশ্রয় নিতে হয়েছে। অথচ প্রকৃত স্বাধীনতার মানে শুধু ভৌগোলিক সীমানা রক্ষা নয়, বরং নীতিতে, কূটনীতিতে ও অর্থনীতিতে আত্মনির্ভর হওয়া। সেই জায়গাতেই নেপাল পিছিয়ে পড়েছে।
আজকের তরুণ প্রজন্মের সামনে তাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—এই দোদুল্যমানতা থেকে মুক্তি নিয়ে সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব যদি নিজেদের স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিতে পারে, তবে নেপাল কেবল পাহাড়ের দেশ নয়, এক আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠবে।
উপসংহার – গণতন্ত্রের অনন্ত যাত্রা
নেপালের সংগ্রাম শেষ হয়নি। এটি এক চলমান যাত্রা—যেখানে স্বাধীনতার স্বপ্ন মিশে আছে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে। হিমালয়ের মতোই তাদের চ্যালেঞ্জ কঠিন, কিন্তু একই সঙ্গে সেই শৃঙ্গের মতোই তাদের দৃঢ়তা অটল।
আজকের নেপাল বারবার ভেঙে পড়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। এ যেন এক দার্শনিক সত্য: গণতন্ত্র কোনো গন্তব্য নয়, বরং এক অনন্ত যাত্রা। আর এই যাত্রায় নেপালের মানুষই প্রকৃত নায়ক।
Comments
Post a Comment