ভোটহীন কোটি প্রাণ: প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও বাংলাদেশের দায়”


পর্ব ২ 

বিশ্বে প্রবাসী ভোটাধিকার: সফল উদাহরণ ও বাংলাদেশে সম্ভাবনা


"প্রায় এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী—তাদের কি কোনো গণতান্ত্রিক অধিকার নেই?”


বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৩০টির বেশি দেশে প্রবাসীদের ভোটাধিকার কার্যকর রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, মেক্সিকো—সবাই প্রবাসীদের ভোটের আওতায় এনেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী বাধা? এই ধারাবাহিক লেখায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে আইনি কাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বাস্তব চ্যালেঞ্জ।


ভূমিকা

বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশই তাদের প্রবাসীদের অর্থনৈতিক অবদানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। কিন্তু রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, বিশেষ করে ভোটাধিকার নিশ্চিত করা নিয়ে দেশভেদে পার্থক্য স্পষ্ট। উন্নত দেশগুলো প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নতুন প্রযুক্তি এবং নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অথচ বাংলাদেশে এই প্রশ্নটি এখনও আলোচিত ও বিতর্কিত। এই লেখায় আমরা দেখব কিভাবে বিভিন্ন দেশ তাদের প্রবাসীদের ভোটের সুযোগ দিয়েছে, কোন মডেলগুলো সফল হয়েছে, এবং বাংলাদেশ এ থেকে কী শিখতে পারে।

ভারতের ডাকযোগে ভোট ব্যবস্থা

ভারতীয় প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ডাকযোগে ভোট একটি কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারত সরকার ‘ইলেকট্রনিকালি ট্রান্সমিটেড পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম’ (ETPBS) চালু করেছে, যার মাধ্যমে প্রবাসীরা ডাকযোগে ব্যালট পাঠাতে পারে।

প্রক্রিয়া: 

ভোটার তালিকায় নাম থাকা প্রবাসীরা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে ডাকযোগে ব্যালট পেয়ে যায়।

সুবিধা: 

শারীরিকভাবে দেশে না ফিরেও ভোট দেওয়া যায়।

চ্যালেঞ্জ: 

ডাক বিলম্ব বা নিরাপত্তা ঝুঁকি।

বাংলাদেশ চাইলে ভারতীয় মডেল অনুসরণ করে ডাকযোগে ভোট চালু করতে পারে।

পাকিস্তানের অনলাইন ভোটিং উদ্যোগ

পাকিস্তান ২০১৮ সালে প্রবাসীদের জন্য অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থা চালু করেছিল। যদিও এটি পরীক্ষামূলক ছিল, তবে এটি প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

সুবিধা: 

সময় ও খরচ কম।

সমস্যা: 

নিরাপত্তা ঝুঁকি ও হ্যাকিং আশঙ্কা।

বাংলাদেশের জন্য অনলাইন ভোটিং একটি সম্ভাবনা হলেও নিরাপত্তা নিশ্চিতে শক্তিশালী সাইবার অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।

ফিলিপাইনের ই-ভোটিং মডেল

ফিলিপাইন প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম অগ্রগামী দেশ। তারা দূতাবাস ও কনস্যুলেটভিত্তিক ভোটিং বুথ চালু করেছে এবং ই-ভোটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।

প্রক্রিয়া: 

প্রবাসীরা দূতাবাসে গিয়ে ভোট দিতে পারে অথবা নির্দিষ্ট পোর্টাল ব্যবহার করে অনলাইনে ভোট প্রদান করে।

সুবিধা: 

দ্রুত ও নির্ভুল গণনা।

শিক্ষণীয় দিক:

 ফিলিপাইনের মডেল বাংলাদেশেও প্রয়োগযোগ্য হতে পারে, বিশেষত সৌদি আরব, মালয়েশিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশে, যেখানে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী আছে।

ইউরোপের সফল উদাহরণ

ফ্রান্স, ইতালি, এবং জার্মানি তাদের প্রবাসীদের ভোটাধিকারে অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে।

ফ্রান্সে প্রবাসীদের জন্য আলাদা নির্বাচনী আসন নির্ধারিত।

ইতালিতে প্রবাসীরা ডাকযোগে ভোট দিতে পারে।

জার্মানি অনলাইন নিবন্ধনের মাধ্যমে ভোটার তালিকা তৈরি করে।

এই দেশগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো প্রযুক্তি এবং নীতি উভয় ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা।

আমেরিকা ও কানাডার মডেল

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা প্রবাসী নাগরিকদের ভোট দেওয়ার জন্য সহজীকৃত ডাকব্যবস্থা চালু করেছে। মার্কিন সেনাবাহিনী এবং বিদেশে থাকা নাগরিকরা ডাকযোগে ভোট পাঠাতে পারে।

সুবিধা: 

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নাগরিকদের অংশগ্রহণ।

চ্যালেঞ্জ:

 ডাক বিলম্ব এবং প্রশাসনিক খরচ।

বাংলাদেশের করণীয়: কোন মডেল উপযুক্ত?

বিশ্বের এসব উদাহরণ থেকে বাংলাদেশের জন্য দুটি মডেল কার্যকর হতে পারে:

1. দূতাবাসভিত্তিক ভোটিং বুথ: সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, আমিরাতের মতো দেশে ভোট বুথ স্থাপন।

2. ডাকযোগে ভোট: ভারতীয় মডেল অনুসারে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা।

চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

যদিও বিশ্বে প্রবাসী ভোটিং ব্যাপকভাবে সফল, তবু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে:

নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে অনলাইন ভোটিং শুরু করা ঝুঁকিপূর্ণ।

ডাকযোগে ভোট ব্যবস্থা চালু করতে নীতি ও আইনগত পরিবর্তন দরকার।

নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

প্রযুক্তির ভূমিকা

ই-ভোটিং সিস্টেম ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নির্বাচনকে বদলে দিতে পারে।

বায়োমেট্রিক সনাক্তকরণ: ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফেস রিকগনিশন ব্যবহার।

OTP নিরাপত্তা: প্রতিটি ভোটারের জন্য ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড।

স্বচ্ছ গণনা: ডিজিটাল গণনার ফলে ফলাফল দ্রুত ও সঠিকভাবে ঘোষণা।

আমাদের শেখার বিষয়

বাংলাদেশের উচিত বিশ্বের মডেলগুলো থেকে শিখে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নেওয়া।

1. প্রথম ধাপ: দূতাবাসভিত্তিক ভোটিং শুরু।

2. দ্বিতীয় ধাপ: ডাকযোগে ভোটিং পরীক্ষামূলক চালু।

3. তৃতীয় ধাপ: নিরাপদ ই-ভোটিংয়ের দিকে অগ্রসর হওয়া।

উপসংহার

বিশ্বের উদাহরণ থেকে স্পষ্ট যে প্রবাসীদের ভোটাধিকার কার্যকর করা সম্ভব। বাংলাদেশের জন্য এখন দরকার প্রযুক্তি, স্বচ্ছ নীতি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। একটি সুশৃঙ্খল পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করলে তারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয় অংশ নিতে পারবে, যা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।






Comments

Popular posts from this blog

বাংলাদেশে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণের নতুন অধ্যায় – জাতিসংঘ অফিসের প্রস্তাব কী নির্দেশ করে।

পিআর চালুর বাস্তব রোডম্যাপ: বাংলাদেশে পরবর্তী ৫ বছরে কীভাবে শুরু করা সম্ভব?”

জুলাই ঘোষণাপত্র: একটি জাতির সংকল্প ও বৈশ্বিক অনুরণন