প্যাট্রিস লুমুম্বা: কঙ্গোর স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক



          প্যাট্রিস লুমুম্বা- কঙ্গোর স্বাধীনতার প্রতীক 

একজন ডাকবাহক থেকে কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রী—যার স্বপ্ন, সাহস ও আত্মত্যাগ আজও আফ্রিকার মুক্তির প্রেরণা।

১৯৬০ সালের ৩০ জুন। লিওপোল্ডভিল (আজকের কিনশাসা) শহরের স্বাধীনতা উৎসবের মঞ্চে বসে ছিলেন বেলজিয়ামের রাজা বোদোয়াঁ এবং কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বা। রাজা বলছিলেন—“বেলজিয়ামের কল্যাণে তোমরা সভ্য হয়েছো।” কিন্তু মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে লুমুম্বা যা বললেন, তা উপনিবেশবাদীদের হৃদয়ে বজ্রাঘাত করল। তিনি ঘোষণা করলেন—“আমরা নিজের রক্ত, অশ্রু আর ঘামের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের স্বাধীনতা কেউ উপহার দেয়নি।” সেই দিন থেকেই লুমুম্বা শুধু কঙ্গোর নয়, সমগ্র আফ্রিকার বিদ্রোহী আত্মার প্রতীক হয়ে ওঠেন।

এই ব্লগে আমরা জানব প্যাট্রিস লুমুম্বার শৈশব, রাজনৈতিক উত্থান, কঙ্গোর স্বাধীনতার সংগ্রাম, পশ্চিমা ষড়যন্ত্র, তাঁর হত্যাকাণ্ড এবং কীভাবে তিনি আজও বিশ্বে অবিনাশী অনুপ্রেরণার প্রতীক।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা

১৯২৫ সালের ২ জুলাই, বেলজিয়ান কঙ্গোর ওনালুয়া গ্রামে জন্ম নেন প্যাট্রিস এমেরি লুমুম্বা। সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম হলেও তাঁর চোখ ছিল দূরের দিগন্তে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন ও কৌতূহলী। গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, তিনি শহরে গিয়ে মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। বেলজিয়ান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করলেও লুমুম্বা দ্রুতই বুঝতে পারেন, এই শিক্ষা ব্যবস্থার আড়ালে লুকিয়ে আছে উপনিবেশিক শোষণের কৌশল।

ডাকবাহক থেকে লেখক

পড়াশোনা শেষ করে তিনি ডাকবিভাগে চাকরি নেন। ডাকবাহক হিসেবে কাজ করার সময় লুমুম্বা কঙ্গোর বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন এবং প্রত্যক্ষ করেন মানুষের দারিদ্র্য, বেলজিয়ান শাসনের নিপীড়ন ও শোষণ। এই সময়েই তিনি লেখালিখি শুরু করেন। তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলোতে ফুটে উঠতে থাকে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং শোষণবিরোধী চেতনা।

কঙ্গোর উপনিবেশিক বাস্তবতা

কঙ্গো ছিল বেলজিয়ামের সবচেয়ে লাভজনক উপনিবেশ। তামা, কোবাল্ট, ইউরেনিয়াম, হীরক—সবই কঙ্গোর মাটি থেকে লুটে নেওয়া হতো। অথচ স্থানীয় জনগণ পাচ্ছিল না শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা মৌলিক মানবাধিকার। সাদা আর কালোর মধ্যে ছিল কঠোর বিভাজন। এই বৈষম্য লুমুম্বার মনে ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

রাজনীতিতে প্রবেশ

১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে লুমুম্বা কঙ্গোর রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি গঠন করেন Mouvement National Congolais (MNC)—একটি বহুজাতিক ও ঐক্যবাদী দল, যার লক্ষ্য ছিল একীভূত ও স্বাধীন কঙ্গো। লুমুম্বা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, কঙ্গো যদি জাতিগত বিভাজনের উর্ধ্বে না উঠতে পারে, তবে স্বাধীনতার স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যাবে।

স্বাধীনতার লড়াই ও প্রধানমন্ত্রী হওয়া

১৯৬০ সালের নির্বাচনে MNC সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং ৩০ জুন ১৯৬০ কঙ্গো স্বাধীনতা লাভ করে। জোসেফ কাসাভুবু রাষ্ট্রপতি হন এবং প্যাট্রিস লুমুম্বা হন প্রথম প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীনতার দিন রাজা বোদোয়াঁর উপনিবেশবাদের প্রশংসামূলক বক্তব্যের জবাবে লুমুম্বার ভাষণ ইতিহাসে অমর হয়ে আছে—সেটি ছিল সাহস, সত্য ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র।

পশ্চিমা ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক সংকট

কিন্তু স্বাধীনতার অল্প কিছুদিন পরেই কঙ্গোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। কাতাঙ্গা প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা পশ্চিমা শক্তি ও বেলজিয়ামের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ঘটেছিল, কারণ কাতাঙ্গা ছিল খনিজসমৃদ্ধ অঞ্চল। লুমুম্বা জাতীয় ঐক্য রক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা চান, যা যুক্তরাষ্ট্র ও বেলজিয়ামের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের কারণ হয়। পশ্চিমা মিডিয়ায় তাঁকে "কমিউনিস্ট" বলে প্রচার করা হয়।

গ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ড

১৯৬০ সালের শেষদিকে লুমুম্বা গ্রেপ্তার হন। ১৯৬১ সালের ১৭ জানুয়ারি, পশ্চিমা সমর্থিত কঙ্গোলিজ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। পরে জানা যায়, সিআইএ ও বেলজিয়ান গোয়েন্দারা তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় জড়িত ছিল। তাঁর দেহ অ্যাসিডে গলিয়ে ফেলা হয়, যাতে তাঁর সমাধি না থাকে—কিন্তু তাঁর নাম ও আদর্শ মুছে ফেলা যায়নি।

উত্তরাধিকার ও অনুপ্রেরণা

লুমুম্বা আজও আফ্রিকার মুক্তির প্রতীক। নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে থমাস সানকারা—অসংখ্য নেতা তাঁর জীবন থেকে প্রেরণা নিয়েছেন। কঙ্গো ও আফ্রিকার বহু শহরে তাঁর নামে সড়ক, স্কুল ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০২২ সালে বেলজিয়াম তাঁর একমাত্র অবশিষ্ট দাঁত কঙ্গোকে ফেরত দেয়—যা ছিল তাঁর হত্যাকাণ্ডের এক নীরব স্বীকৃতি।

আজকের পাঠ

প্যাট্রিস লুমুম্বা শিখিয়েছেন—স্বাধীনতা উপহার নয়, এটি রক্ত ও ঘামের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়। ক্ষমতা, ষড়যন্ত্র ও শোষণের মুখে দাঁড়িয়ে সত্য বলা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু সেটিই একজন প্রকৃত নেতার গৌরব।






Comments

Popular posts from this blog

বাংলাদেশে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণের নতুন অধ্যায় – জাতিসংঘ অফিসের প্রস্তাব কী নির্দেশ করে।

পিআর চালুর বাস্তব রোডম্যাপ: বাংলাদেশে পরবর্তী ৫ বছরে কীভাবে শুরু করা সম্ভব?”

জুলাই ঘোষণাপত্র: একটি জাতির সংকল্প ও বৈশ্বিক অনুরণন