জোমো কেনিয়াট্টা: কেনিয়ার স্বাধীনতার জনক – এক বিপ্লবী নেতা ও জাতির পিতা

           

নেতা ও কেনিয়ার জাতির পিতা 

কেনিয়ার প্রান্তর জুড়ে ভোরের প্রথম আলো যখন মাঠের ধানক্ষেতের সবুজের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন এক তরুণের পদচারণা যেন কেবল গ্রামের পথ নয়, বরং ইতিহাসের পথে। চোখে দীপ্তি, মননে দেশপ্রেম—এই মানুষটি একদিন হয়ে উঠবেন কেনিয়ার জাতির পিতা। তিনি ছিলেন জোমো কেনিয়াট্টা—যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি স্বাধীন, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী কেনিয়া।


জোমো কেনিয়াট্টা ছিলেন কেনিয়ার স্বাধীনতার সংগ্রামী নেতা এবং দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি ছিলেন এক বিপ্লবী চিন্তাবিদ, যিনি ক্ষমতা নয়, জনগণের কল্যাণকে সর্বাগ্রে রাখতেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ভেঙে স্বাধীন কেনিয়ার জন্য তার নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তাকে আফ্রিকান ইতিহাসের এক অমর ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

শৈশব ও পারিবারিক জীবন

জোমো কেনিয়াট্টা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৭ সালের ২০ অক্টোবর, কেনিয়ার কিকুয়ু সম্প্রদায়ের একটি গ্রামে। তার পিতা কিকুয়ু সম্প্রদায়ের একজন স্থানীয় নেতা ছিলেন, কিন্তু পরিবারের জীবন ছিল অতি সরল ও স্বল্প সম্পদে সীমিত। ছোটবেলা থেকেই জোমো ছিলেন কৌতূহলী, প্রতিভাবান এবং তীক্ষ্ণ মনোযোগী। গ্রামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তার মানসপটকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল।

তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন গ্রামের স্কুলে, যেখানে শিক্ষকতা মূলত ধর্মীয় এবং মৌলিক পড়াশোনায় সীমিত ছিল। ছোটবেলায় তিনি গ্রামের অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মাঠে খেলার পাশাপাশি নিজের পরিবারের ক্ষুদ্র জমিতে কৃষিকাজ শিখতেন। পিতার কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সমাজসেবার মূল্য।

তরুণ বয়সে মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থা এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বাস্তবতা পরিচয় করায় তার রাজনৈতিক চেতনা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে লন্ডন ও পারিসে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন, যেখানে তিনি পশ্চিমা দর্শন, সমাজতত্ত্ব এবং রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন।

প্রারম্ভিক রাজনৈতিক জীবন



               

 রাজনৈতিক জীবন, ১৯৬৪


কেনিয়ার গ্রামীণ জনগণ তখনও দারিদ্র্য, নিপীড়ন এবং ভূমি দখলের সমস্যার শিকার। জোমো কেনিয়াট্টা ব্রিটিশ শাসকদের কাছে কৃষক ও সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের নেতা হন। তিনি ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কেন্যন আফ্রিকান ইউনিয়ন (KAU), যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় বাহিনী হয়ে ওঠে।

কেনিয়াট্টা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে বৈঠক, জনসভায় বক্তৃতা, সভা ও সমাবেশ—সবকিছুই তার জনপ্রিয়তার কারণ। তার ভাষণ ছিল সহজবোধ্য, হৃদয়স্পর্শী এবং প্রভাবশালী। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের জন্য তিনি প্রায়ই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ নেতা ছিলেন। কখনও তিনি রাজনৈতিক কারাগারে আটক হন, কিন্তু এর মাধ্যমে তার প্রতিজ্ঞা আরও দৃঢ় হয়।

স্বাধীনতার সংগ্রাম

১৯৫০-এর দশকে কেনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতায় পৌঁছায়। জোমো কেনিয়াট্টা ছিলেন অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা, মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি থেকে অনুপ্রাণিত। তিনি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় দক্ষতার সঙ্গে দেশকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যান।

KAU-র নেতৃত্বে তিনি প্রচার করেন শিক্ষার প্রসার, কৃষক সমবায়, এবং রাজনৈতিক সচেতনতা। তার শপথ ও বক্তব্যে মানুষের মনে গভীর আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। কৃষক থেকে শহরের শিক্ষিত যুবক—সবাই তার প্রেরণায় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।

১৯৬৩ সালে কেনিয়া স্বাধীনতা অর্জন করে। জোমো কেনিয়াট্টা হন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। শপথ গ্রহণের ভাষণে তিনি বলেন:

 “আমরা আজ স্বাধীন, কিন্তু আমাদের কাজ এখনো শুরু। দেশের উন্নয়ন, সমতা ও ঐক্য আমাদের প্রধান লক্ষ্য।”

রাষ্ট্রপতি হিসেবে নেতৃত্ব ও নীতি

প্রধান রাষ্ট্রপতি হিসেবে জোমো কেনিয়াট্টা কৃষি, শিক্ষা, অবকাঠামো, এবং সামাজিক ন্যায়ের ক্ষেত্রে বিস্তৃত নীতি গ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি শক্তিশালী জাতি গড়ে তোলা যায় গ্রামীণ জনগণকে শক্তিশালী করে।



                      গ্রামীণ  কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প 

তিনি চালু করেন:

কৃষক সমবায় প্রকল্প: গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করতে

শিক্ষা ও স্কুল প্রতিষ্ঠা: গ্রামীণ যুবক-যুবতীদের শিক্ষিত করতে

স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি: স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সচেতনতা এবং হাসপাতাল নির্মাণ

নাগরিক শিক্ষা: জনগণকে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে সচেতন করা

কেনিয়াট্টার নীতিগুলো প্রায়শই সমালোচনার মুখোমুখি হয়, বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে। তবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সংযোগ এবং সত্যনিষ্ঠা তাকে জনপ্রিয় রাখে।

আন্তর্জাতিক ভূমিকা ও আফ্রিকান ঐক্য

জোমো কেনিয়াট্টা ছিলেন আফ্রিকান ইউনিটি অর্গানাইজেশনের (OAU) প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক। তার দেশ জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিত।

তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে শান্তি, ন্যায় এবং আফ্রিকান ঐক্যের কণ্ঠস্বর ছিলেন। বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি অংশ নেন, এবং পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় দক্ষতা দেখান।

ব্যক্তিগত জীবন ও উত্তরাধিকার

জোমো কেনিয়াট্টা ছিলেন বিনয়ী, সৎ এবং পরিশ্রমী। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও তার জীবনযাপন ছিল সরল। তিনি বলতেন:

“শক্তি মানুষের কল্যাণে প্রমাণ করতে হয়, ক্ষমতায় নয়।”

১৯৭৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কেনিয়ার জনগণ আজও তাকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে শ্রদ্ধা করে। তার নেতৃত্ব, নীতি এবং দর্শন নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে।

উল্লেখযোগ্য উক্তি

 “একটি স্বাধীন কেনিয়া গড়তে হলে আমাদের ঐক্য, শিক্ষা এবং দৃঢ় সংকল্প প্রয়োজন।”

“শক্তি ক্ষমতায় নয়, জনগণের কল্যাণে প্রমাণ করতে হয়।”










Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প