বিশ্বে গণতান্ত্রিক মনোনয়ন মডেল – প্রাইমারি নির্বাচন

 পর্ব ২: 

ভূমিকা

গণতন্ত্রের প্রাণ হলো জনগণের অংশগ্রহণ। কিন্তু শুধুমাত্র সাধারণ নির্বাচনে ভোট দেওয়া নয়, বরং দলের প্রার্থী নির্ধারণের ক্ষেত্রেও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। এজন্য প্রাইমারি নির্বাচন (Primary Election) মডেল বিশ্বের অনেক উন্নত গণতন্ত্রে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এটি একটি প্রক্রিয়া যেখানে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী নির্বাচিত হয় সরাসরি দলের নিবন্ধিত সদস্য বা ভোটারদের ভোটের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়া দলীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এবং প্রার্থীর জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সবচেয়ে স্বচ্ছ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

বাংলাদেশে এখনো প্রাইমারি নির্বাচন প্রচলিত নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স এবং আরও অনেক দেশ সফলভাবে এটি ব্যবহার করছে। আজকের আলোচনায় আমরা বিশ্বে প্রাইমারি নির্বাচন মডেল এবং এর কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করব।

প্রাইমারি নির্বাচনের মূল ধারণা

প্রাইমারি নির্বাচন মূলত দলীয় প্রার্থী নির্ধারণের একটি পদ্ধতি। এখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চেয়ে সদস্য ও ভোটারদের মতামত প্রাধান্য পায়। প্রার্থীরা সাধারণ জনগণ বা দলীয় ভোটারদের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, এবং ভোটে বিজয়ী প্রার্থীই দলের মনোনীত প্রতিনিধি হন।

প্রাইমারি নির্বাচনের দুই ধরনের প্রচলিত রূপ আছে:

1. ওপেন প্রাইমারি (Open Primary): 

যেখানে যে কোনো ভোটার প্রার্থী বাছাইয়ে অংশ নিতে পারে, দলীয় সদস্য হওয়া জরুরি নয়।

2. ক্লোজড প্রাইমারি (Closed Primary): 

শুধুমাত্র দলীয় নিবন্ধিত সদস্যরা প্রার্থী বাছাইয়ে ভোট দিতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাইমারি মডেল

যুক্তরাষ্ট্র প্রাইমারি নির্বাচনের সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ। এখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থীরা রাজ্যভিত্তিক প্রাইমারি ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

কীভাবে হয়:

প্রার্থীরা রাজ্যভিত্তিক প্রচারণা চালান।

ভোটাররা (দলীয় বা সাধারণ) তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন।

ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে ‘ডেলিগেট’ সংখ্যা নির্ধারিত হয়।

সর্বাধিক ডেলিগেট অর্জনকারী প্রার্থী দলের চূড়ান্ত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন।

সুবিধা:

প্রার্থী নির্বাচনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ।

টাকার চেয়ে জনপ্রিয়তা ও নীতি বেশি গুরুত্ব পায়।

প্রার্থীর যোগ্যতা এবং ভোটার সংযোগ আগে থেকেই যাচাই হয়।

চ্যালেঞ্জ:

বিপুল অর্থ ব্যয়।

দীর্ঘ ও জটিল প্রচারণা প্রক্রিয়া।

যুক্তরাজ্যের কনস্টিটিউয়েন্সি ভিত্তিক পদ্ধতি

যুক্তরাজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পূর্ণাঙ্গ প্রাইমারি না থাকলেও, কনস্টিটিউয়েন্সি অ্যাসোসিয়েশন নামে স্থানীয় কমিটি প্রার্থী নির্বাচনে মূল ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় কনজারভেটিভ বা লেবার পার্টির স্থানীয় সংগঠন প্রার্থীর তালিকা তৈরি করে এবং স্থানীয় সদস্যদের ভোটে প্রার্থী চূড়ান্ত হয়।

এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য:

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বদলে স্থানীয় সদস্যদের প্রভাব।

প্রার্থীর স্থানীয় জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ।

অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করা।

ইউরোপীয় দেশগুলোর অভিজ্ঞতা

জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেনসহ অনেক ইউরোপীয় দেশে প্রার্থীদের Candidate Ranking System এর মাধ্যমে বাছাই করা হয়। এখানে দলীয় সদস্যরা ভোট দিয়ে প্রার্থীদের একটি র‌্যাঙ্ক তৈরি করেন। সর্বাধিক ভোট বা র‌্যাঙ্কে থাকা প্রার্থীরাই নির্বাচনে অংশ নেন।

ফ্রান্সে কিছু দল যেমন Les Républicains এবং Parti Socialiste, ওপেন প্রাইমারি পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্বাচন করে। সাধারণ ভোটাররাও ভোটে অংশ নেন।

কানাডার উদাহরণ

কানাডায় দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে Nomination Contest বা Riding Nomination হয়। স্থানীয় সদস্যদের সরাসরি ভোটে প্রার্থী নির্বাচিত হয়। এর ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রভাব সীমিত থাকে।

প্রাইমারি মডেলের সুবিধা

1. দলীয় গণতন্ত্র বৃদ্ধি: সিদ্ধান্ত আর কেবল শীর্ষ নেতৃত্বের হাতে থাকে না।

2. জনগণের অংশগ্রহণ: ভোটাররা প্রার্থী বাছাইয়ে সরাসরি অংশ নেয়।

3. জনপ্রিয়তা যাচাই: প্রার্থীর জনসমর্থন আগে থেকেই প্রমাণিত হয়।

4. নতুন নেতৃত্বের উত্থান: কেন্দ্রীয় নেতাদের ছায়া থেকে বেরিয়ে নতুন প্রার্থীদের সুযোগ তৈরি হয়।

বাংলাদেশে প্রাইমারি নির্বাচন – কেন প্রয়োজন?

বাংলাদেশে প্রাইমারি নির্বাচন চালু হলে কয়েকটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে:

কেন্দ্রের একক প্রভাব কমে যাবে।

দলীয় জনপ্রিয় নেতা ও তৃণমূলের প্রতিনিধি সহজেই প্রার্থী হতে পারবেন।

অর্থবল বা ক্ষমতার আধিপত্য হ্রাস পাবে।

সাধারণ মানুষ প্রার্থী বাছাইয়ে আস্থা পাবে।

চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা

তবে বাংলাদেশে প্রাইমারি নির্বাচন চালু করতে হলে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে:

1. দলীয় মানসিকতা পরিবর্তন: শীর্ষ নেতৃত্বকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে আগ্রহী হতে হবে।

2. প্রযুক্তিগত অবকাঠামো: ভোটার তালিকা তৈরি ও ভোটিং পদ্ধতি আধুনিকায়ন দরকার।

3. অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা: নির্বাচনী খরচ কমানোর জন্য আইনগত সংস্কার।

উপসংহার

বিশ্বে প্রাইমারি নির্বাচন দলীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পরীক্ষিত পদ্ধতি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের উদাহরণ প্রমাণ করে যে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া প্রার্থী বাছাই গণতান্ত্রিক হতে পারে না। বাংলাদেশে প্রাইমারি নির্বাচন চালু হলে এটি শুধু মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনবে না, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।






Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প