প্রথম পর্ব : ভোট হীন কোটি প্রাণ: প্রবাসীদের ভোটাধিকার ও বাংলাদেশের দায়”


প্রবাসীদের ভোটাধিকার: চ্যালেঞ্জ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

"যারা রেমিট্যান্সে দেশ চালায়, তারাই কেন ভোটে অংশ নিতে পারে না?”

ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তার পেছনে দেশের প্রবাসী শ্রমজীবী মানুষের অবদান অসামান্য। তারা বিদেশের মাটিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি প্রদান করছে। শুধু অর্থনৈতিক দিক নয়, দেশের উন্নয়ন, সামাজিক পরিবর্তন, এবং রাজনৈতিক অগ্রগতিতেও তাদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে—প্রবাসীরা কি তাদের ভোটাধিকার কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারছে? বাংলাদেশের প্রবাসীদের জন্য ভোটদান পদ্ধতি এখনও সীমাবদ্ধ ও জটিল, যা আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশে প্রবাসী ভোটাধিকার: বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার রয়েছে। প্রবাসীদের ক্ষেত্রেও এই অধিকার বাতিল হয়নি, তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একাধিক সমস্যা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুসারে প্রবাসীরা যদি জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) রাখে এবং ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করে, তবে দেশে এসে ভোট দিতে পারবে। কিন্তু যারা বিদেশে বসবাস করছে, তাদের জন্য ভোট দেওয়ার কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা বর্তমানে নেই।

অতীতে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ডাকযোগে ভোট বা অনলাইন ভোটিংয়ের প্রস্তাব উঠেছিল, কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ও নিরাপত্তা জটিলতার কারণে এই উদ্যোগগুলো কার্যকর হতে পারেনি।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

বিশ্বের অনেক দেশ প্রবাসীদের ভোটাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত ডাকযোগে ভোটের অনুমতি দেয়। ফিলিপাইন ই-ভোটিং ও দূতাবাসভিত্তিক ভোটিং সিস্টেম চালু করেছে। ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা প্রবাসীদের ডাকযোগে ভোট প্রদান এবং কনস্যুলেটে ভোটের ব্যবস্থা করেছে।

এই মডেলগুলো থেকে বাংলাদেশের শেখার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে, ফিলিপাইনের দূতাবাসভিত্তিক ভোটিং এবং ভারতীয় ডাকযোগে ভোটিং সিস্টেম আমাদের প্রবাসীদের জন্য বাস্তবসম্মত হতে পারে। যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তবে ধীরে ধীরে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

প্রবাসীদের ভোটাধিকার কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বাংলাদেশের প্রবাসীরা বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠান, যা দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু তারা যখন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে ভোটের মাধ্যমে মতামত জানাতে পারে না, তখন একধরনের বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি হয়।

গণতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের কণ্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্তি শুধু ভোটের মাধ্যমে নয়, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। প্রবাসী সম্প্রদায় সবসময় দেশের উন্নয়ন, শিক্ষা ও সামাজিক উদ্যোগে অবদান রাখে। তাই ভোটের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা ন্যায্য নয়।

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

প্রবাসীদের ভোটাধিকার কার্যকর করার ক্ষেত্রে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

1. প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা: অনলাইন ভোটিং বা ডাকযোগে ভোট দিলে ভোট কারচুপি বা হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি থাকে।

2. প্রশাসনিক ব্যয়: প্রবাসীদের জন্য আলাদা ভোট ব্যবস্থা চালু করতে খরচ অনেক বেশি।

3. রাজনৈতিক অনীহা: রাজনৈতিক দলগুলো প্রবাসী ভোটারদের প্রভাব নিয়ে দ্বিধান্বিত।

4. লজিস্টিক সমস্যা: বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীদের জন্য একযোগে ভোট ব্যবস্থা তৈরি জটিল।

প্রযুক্তিগত  সমাধান ও ভবিষ্যতের পথ

প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ই-ভোটিং সিস্টেম ধীরে ধীরে বিশ্বের অনেক দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। বায়োমেট্রিক যাচাই, ফেস রিকগনিশন বা ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড (OTP) প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে নিরাপদ ভোট দেওয়া সম্ভব।বাংলাদেশের বর্তমান স্মার্ট কার্ড, অনলাইন পাসপোর্ট, ডিজিটাল এনআইডি ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নিরাপদ ই-ভোটিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সমন্বয় জরুরি।বিশেষ করে ইন্টারনেট কানেক্টিভিটি শক্তিশালী করতে হবে,বিশেষ সাইবার সিকিউরিটি টিম গঠন করতে হবে,বিদশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর আইটি সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

একটি পাইলট প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে যেখানে প্রথমে দূতাবাসে ভোট বুথ স্থাপন করা হবে। ধীরে ধীরে অনলাইন ভোটিংয়ের ব্যবস্থা চালু করা যাবে। 

সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্ক

প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ মনে করে প্রবাসীদের ভোটে রাজনৈতিক প্রভাবের ভারসাম্য পরিবর্তন হতে পারে। দেশে বসবাসকারী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর প্রবাসীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি অনেক দলকে অস্বস্তিতে ফেলে। তবে গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হলে এই ভয় দূর করতে হবে।

 অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন এটি গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।

এছাড়া, প্রবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন এবং বিদেশে ভোটের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবু সময়ের দাবি হলো একটি ন্যায়সঙ্গত ও স্বচ্ছ পদ্ধতি তৈরি করা।

প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় বড় অবদান রাখছে।

রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে তাদের বাদ দেওয়া অন্যায়।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও উপসংহার

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে ভোট ব্যবস্থাকেও আধুনিক করতে হবে। প্রবাসীরা দেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা গেলে গণতন্ত্রে আরও অন্তর্ভুক্তি আসবে।

ভবিষ্যতে যদি ই-ভোটিং চালু হয়, তবে শুধু প্রবাসীরা নয়, দেশের ভেতরেও ভোটের স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণ বাড়বে। প্রবাসীদের জন্য একটি বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।











Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প