চতুর্থ পর্ব : এমিলিও আগুইনালদো: ফিলিপাইনের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও স্বাধীনতার ঘোষক।


এমিলিও আগুইনালদো,ফিলিপাইনের স্বাধীনতার ঘোষক 

সাবটাইটেল

স্পেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যিনি ফিলিপাইনের স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেছিলেন।


পাঠকের প্রতি প্রশ্ন ;

আপনি কি মনে করেন, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে নেতৃত্ব দেওয়া আর ক্ষমতায় টিকে থাকা – এই দুইয়ের মধ্যে কোনটা বেশি কঠিন?


ভূমিকা

ফিলিপাইনের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্য ও বিতর্কিত নাম হলো এমিলিও আগুইনালদো (1869–1964)। তিনি ছিলেন বিপ্লবী, সামরিক নেতা এবং ফিলিপাইনের প্রথম প্রেসিডেন্ট। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি ফিলিপাইন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন—যা এশিয়ার প্রথম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু তার জীবন কেবল গৌরবের গল্প নয়, বরং দ্বন্দ্ব, বিতর্ক ও সমালোচনার সমষ্টি। তিনি যেমন স্পেনীয় ঔপনিবেশিক শাসন ভেঙে দিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে মুখোমুখি হয়েছিলেন এক কঠিন বাস্তবতার।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

জন্ম ও পরিবার

জন্ম: ২২ মার্চ, ১৮৬৯

জন্মস্থান: কাওইতে প্রদেশের কাওইতে এল ভিয়েজো (বর্তমানে কাওইতে শহর)

পরিবার: ধনী জমিদার পরিবার

শিক্ষা

স্থানীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।

আইন অধ্যয়ন শুরু করলেও তা শেষ করতে পারেননি।

অল্প বয়সেই কৃষি ও সামরিক কাজে দক্ষতা অর্জন করেন।

Katipunan আন্দোলনে যোগদান



জেনারেল আগুইনালদো

১৮৯৬ সালে আন্দ্রেস বনিফাসিওর নেতৃত্বে শুরু হওয়া Katipunan বিপ্লবে আগুইনালদো দ্রুতই একজন দক্ষ সামরিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেন।

তিনি কাভিতে প্রদেশে একাধিক যুদ্ধে স্পেনীয় সেনাদের পরাজিত করেন।

এর ফলে তিনি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

বনিফাসিওর সঙ্গে দ্বন্দ্ব

Katipunan আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে বনিফাসিও ও আগুইনালদোর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

১৮৯৭ সালে Tejeros Convention এ আগুইনালদোকে বিপ্লবী সরকারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়।

বনিফাসিও ফলাফল মেনে নেননি।

পরবর্তীতে বনিফাসিওকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এই ঘটনাটি আজও বিতর্কিত, কারণ অনেকের মতে আগুইনালদো ইচ্ছাকৃতভাবে বনিফাসিওকে সরিয়ে দেন।

Biak-na-Bato চুক্তি

১৮৯৭ সালে স্পেনীয়দের সঙ্গে Biak-na-Bato চুক্তি হয়। এর অধীনে আগুইনালদো ও অন্যান্য নেতাদের হংকং-এ নির্বাসনে যেতে হয় এবং বিনিময়ে কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ পান। তবে স্পেন তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।

স্বাধীনতার ঘোষণা (1898)

১৮৯৮ সালে স্পেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে আগুইনালদো ফিলিপাইনে ফিরে আসেন।

১২ জুন, ১৮৯৮

তিনি কাওইতে শহরের নিজের বাড়ির বারান্দা থেকে ফিলিপাইনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।

এটি এশিয়ার প্রথম প্রজাতান্ত্রিক স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল।

ফিলিপাইন প্রজাতন্ত্র ও প্রেসিডেন্সি

১৮৯৯ সালে Malolos Congress এর মাধ্যমে সংবিধান গৃহীত হয় এবং এমিলিও আগুইনালদো ফিলিপাইনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হন।

তিনি নতুন সরকারের সংগঠন গড়ে তোলেন।

বিভিন্ন প্রদেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেন।

তবে এ সময়ই নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ফিলিপাইন–আমেরিকান যুদ্ধ (1899–1902)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনকে স্পেন থেকে কিনে নেয় এবং নতুন শাসন প্রতিষ্ঠা করে।

আগুইনালদো প্রথমে আমেরিকার সহযোগী ভেবেছিলেন, কিন্তু পরে বুঝতে পারেন তারা নতুন উপনিবেশ স্থাপন করছে।

ফলে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী Philippine–American War।

যুদ্ধের ফলাফল

ফিলিপাইন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে।

লাখো মানুষ মারা যায়।

আগুইনালদো শেষ পর্যন্ত ১৯০১ সালে মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পতাকা নামাতে বাধ্য হন।

পরবর্তী জীবন



পরিবারের সঙ্গে আগুইনালদো

যুদ্ধ শেষে আগুইনালদো রাজনীতি থেকে কিছুটা সরে যান, তবে বিভিন্ন সময় সক্রিয় থেকেছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি দখলদারদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক হয়।

১৯৬৪ সালে ৯৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।

আগুইনালদোর দর্শন ও নেতৃত্ব

তিনি বিশ্বাস করতেন, শক্তিশালী সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব নয়।

তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, তবে সমালোচকরা বলেন, তার শাসন অনেক সময় স্বৈরাচারী ছিল।

সমালোচনা ও বিতর্ক

বনিফাসিওর মৃত্যুদণ্ড: অনেকের মতে এটি ছিল আগুইনালদোর রাজনৈতিক কৌশল।

আমেরিকানদের সঙ্গে সমঝোতা: প্রথমে তিনি সমঝোতার চেষ্টা করেন, পরে যুদ্ধ করেন—যা তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভূমিকা: জাপানিদের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগ তার উত্তরাধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে।

উত্তরাধিকার ও প্রভাব

আগুইনালদোকে ফিলিপাইনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাসে স্মরণ করা হয়।

কাওইতে শহরে তার বাড়ি আজও একটি জাতীয় জাদুঘর।

১২ জুনকে ফিলিপাইনের Independence Day হিসেবে পালিত হয়।

তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে তরুণ নেতৃত্বও জাতিকে নতুন পথে নিয়ে যেতে পারে।

আজকের প্রাসঙ্গিকতা

আজকের রাজনৈতিক বিশ্বে আগুইনালদোর জীবন থেকে শেখার মতো কিছু শিক্ষা হলো:

স্বাধীনতার জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত অপরিহার্য।

ঐক্য ও নেতৃত্ব ছাড়া জাতি এগোতে পারে না।

তবে ক্ষমতার লড়াই অনেক সময় আন্দোলনের মূল লক্ষ্যকে বিপদে ফেলে দেয়।

উপসংহার

এমিলিও আগুইনালদো ছিলেন একজন সাহসী সৈনিক ও নেতা, যিনি ফিলিপাইনের স্বাধীনতার ঘোষক। তার জীবন আমাদের শেখায়— স্বাধীনতার পথ কখনো সরল নয়; সেখানে থাকে দ্বন্দ্ব, ত্যাগ, ভুল সিদ্ধান্ত ও বিতর্ক। তবুও তার ঘোষণা, তার সংগ্রাম এবং তার নেতৃত্বই ফিলিপাইন জাতিকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল।


Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প