দ্বিতীয় পর্ব : হোসে রিজাল: ফিলিপাইনের জাতীয় বীর ও স্বাধীনতা সংগ্রামী


হোসে রিজেল, ফিলিপাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামী, বীর 

সাবটাইটেল

একজন চিকিৎসক, লেখক ও শহীদের জীবনী যিনি তাঁর কলমের শক্তিতে একটি জাতিকে স্বাধীনতার পথে উজ্জীবিত করেছিলেন।

Reader’s Question

আপনি কি বিশ্বাস করেন, শুধু একটি কলমের শক্তি কোনো জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিতে পারে?

ভূমিকা

ফিলিপাইনের স্বাধীনতার ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অম্লান থাকবে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র নিঃসন্দেহে হোসে রিজাল (José Protacio Rizal Mercado y Alonzo Realonda)। তিনি ছিলেন চিকিৎসক, কবি, ঔপন্যাসিক, শিল্পী, এবং সর্বোপরি একজন দেশপ্রেমিক যিনি অস্ত্র নয়, কলমকে বেছে নিয়েছিলেন সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে। তাঁর লেখা Noli Me Tangere ও El Filibusterismo ফিলিপাইনের মানুষের মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল। যদিও তিনি সরাসরি সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁর চিন্তা, দর্শন ও আত্মত্যাগই পরবর্তীতে ফিলিপাইন বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা

জন্ম ও পরিবার

হোসে রিজাল জন্মগ্রহণ করেন ১৯ জুন, ১৮৬১ সালে, ফিলিপাইনের ল্যাগুনা প্রদেশের কালাম্বায় এক সমৃদ্ধ ও শিক্ষিত পরিবারে। তার পিতা ফ্রান্সিসকো মেরকাডো রিজাল ছিলেন কৃষক এবং মাতা তেওদোরা আলোনজো ছিলেন শিক্ষিতা ও ধর্মপ্রাণ নারী। ছোটবেলা থেকেই রিজাল ছিলেন বুদ্ধিমান ও কৌতূহলী।

শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় নিজের মায়ের কাছ থেকে।

পরবর্তীতে ম্যানিলার Ateneo Municipal de Manila তে পড়াশোনা করেন এবং কৃতিত্বের সাথে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

তিনি স্পেনের Universidad Central de Madrid এ চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

এছাড়াও ফ্রান্স ও জার্মানিতেও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবনে তিনি বহু ভাষা শিখেছিলেন—স্প্যানিশ, জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি, ল্যাটিন, গ্রিকসহ মোট ২২টিরও বেশি ভাষায় তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

সাহিত্য ও বিপ্লবী চেতনা


মৃত্যুর প্রাক্কালে জাতির প্রতি রিজেলের অমর বিদায়ী বার্তা।

Noli Me Tangere (1887)

এই উপন্যাসে স্পেনীয় শাসকদের দুর্নীতি, পাদ্রীদের ভণ্ডামি এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশা চিত্রিত করা হয়। বইটি প্রকাশের পর ফিলিপাইনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

El Filibusterismo (1891)

এই গ্রন্থে তিনি আরও তীক্ষ্ণভাবে শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেন এবং বিদ্রোহের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

এই দুটি গ্রন্থ ফিলিপাইন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মকাণ্ড



হোসে রিজেল ও পিও ভেনুজুয়েলা- স্বাধীনতার দুই কিংবদন্তি 

রিজাল ছিলেন সংস্কারের পক্ষপাতী। তিনি মনে করতেন, স্পেন যদি ন্যায়পরায়ণ শাসন চালায় তবে ফিলিপাইন স্বাধীন না হলেও নাগরিক অধিকার পেতে পারে। তবে তার কলম এতটাই প্রভাবশালী ছিল যে শাসকশ্রেণি তাকে বিপ্লবী হিসেবে দেখতে শুরু করে।

তিনি La Liga Filipina নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সামাজিক সংস্কারের জন্য কাজ করত। যদিও এটি দ্রুত ভেঙে দেওয়া হয়, তবে এটি ছিল Katipunan এর জন্মের পূর্বাভাস।

নির্বাসন জীবন

১৮৯২ সালে তাকে মিন্দানাও দ্বীপের Dapitan এ নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন, বিদ্যালয় স্থাপন করেন, কৃষিকাজ চালান এবং স্থানীয় জনগণকে উন্নয়নের পথে উদ্বুদ্ধ করেন।

গ্রেপ্তার, বিচার ও মৃত্যুদণ্ড

১৮৯৬ সালে ফিলিপাইনে বিদ্রোহ শুরু হলে রিজালকে দোষী সাব্যস্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও তার বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহে জড়িত থাকার প্রমাণ ছিল না, তবুও তাকে রাজদ্রোহ, ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহ উসকানির অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর


হোসে রিজেল এর শেষ বিষয়, যেখানে বিদায় নয়, জন্ম হয়েছিল অনন্ত  অনুপ্রেরণার 

তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ৩০ ডিসেম্বর, ১৮৯৬ সালে ম্যানিলার Luneta Park (বর্তমানে Rizal Park) এ।

মৃত্যুর আগে তিনি “Mi Último Adiós (আমার শেষ বিদায়)” নামে এক হৃদয়স্পর্শী কবিতা লিখে যান, যা আজও ফিলিপাইন জাতীয় চেতনার প্রতীক।

সমালোচনা ও বিতর্ক

কিছু সমালোচক মনে করেন, রিজাল সশস্ত্র বিপ্লবের বিরোধিতা করে আসলে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিলম্বিত করেছিলেন। আবার অনেকের মতে, তাঁর কলমই ছিল আসল বিপ্লব, কারণ তা মানুষের চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছিল।

উত্তরাধিকার ও প্রভাব

ফিলিপাইনে রিজালকে জাতীয় নায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

দেশের প্রতিটি শহর ও গ্রামে তার নামে রাস্তা, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

Rizal Park ম্যানিলার অন্যতম ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ।

প্রতি বছর ৩০ ডিসেম্বর ফিলিপাইন জুড়ে Rizal Day পালিত হয়।

আজকের প্রাসঙ্গিকতা

আজকের বিশ্বে যেখানে অন্যায়, দুর্নীতি ও বৈষম্য বিরাজমান, সেখানে রিজালের জীবন আমাদের শেখায়—

সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো

শিক্ষার শক্তিতে জাতিকে এগিয়ে নেওয়া

শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের মূল্য

উপসংহার

হোসে রিজাল প্রমাণ করেছিলেন যে, অস্ত্রের চেয়ে কলমের শক্তি অনেক বেশি প্রভাবশালী হতে পারে। তিনি তাঁর লেখনী ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে ফিলিপাইনের মানুষকে স্বাধীনতার পথে উজ্জীবিত করেছিলেন। তার জীবন আমাদের শেখায়— একজন সৎ, শিক্ষিত ও সাহসী মানুষ গোটা জাতিকে বদলে দিতে পারেন।


Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প