তৃতীয় পর্ব : সুকর্ণো: ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার পিতা – এক বিপ্লবী নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক
![]() |
ইন্দোনেশিয়ার সাবেক সুকর্ণো |
জাভা দ্বীপের সবুজ পাথুরে পাহাড়ের মধ্যে, সমুদ্রের ঢেউয়ের ধ্বনিতে এক তরুণের কণ্ঠ যেন ভবিষ্যতের ডাক দিচ্ছিল। চোখে দীপ্তি, মননে দেশপ্রেম—এই মানুষটি একদিন হয়ে উঠবেন ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতা। তিনি ছিলেন সুকর্ণো, যিনি একটি স্বাধীন, ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী ইন্দোনেশিয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
প্রিভিউ
সুকর্ণো ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার সংগ্রামী নেতা এবং দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি ছিলেন এক প্রখর চিন্তাবিদ, যিনি ক্ষমতার জন্য নয়, জনগণের কল্যাণ এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য রাজনীতি করতেন। ডাচ ঔপনিবেশিক শাসন ভেঙে স্বাধীন ইন্দোনেশিয়ার জন্য তার নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা তাকে এশিয়ার ইতিহাসের এক অমর ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
শৈশব ও পারিবারিক জীবন
![]() |
কিশোর সুকর্নো |
সুকর্ণো জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালের ৬ জুন, জাভার ছোট গ্রামে। তার পিতা একজন ডাচ ও জাভা সংস্কৃতির সংমিশ্রণে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন, আর মাতা ছিলেন জাভানিজ মুসলিম পরিবারের সন্তান। ছোটবেলায় সুকর্ণো খুবই জ্ঞানপ্রিয়, চঞ্চল এবং কৌতূহলী। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সময় থেকেই তার নেতৃত্বগুণ প্রকটভাবে প্রকাশ পায়।
তার শৈশব কেবল বিদ্যালয় ও খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি গ্রাম্য সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। পিতার কাছ থেকে তিনি নৈতিকতা, ধৈর্য এবং সামাজিক দায়িত্বের শিক্ষা নেন।
যুবকাবস্থায় তিনি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন, পরে জাভা বিশ্ববিদ্যালয়ে higher education নেন। সেখানে তিনি ডাচ ঔপনিবেশিক শাসন ও আফ্রিকান-এশিয়ান স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন। ইউরোপীয় ও এশিয়ান রাজনৈতিক দর্শন তাঁর চিন্তাধারাকে গভীর প্রভাবিত করে।
রাজনৈতিক জীবনের শুরু
ডাচ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় সুকর্ণো যুবক হিসেবে রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জন করেন। তিনি ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেন এবং শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করেন। ১৯২৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন পার্টাই নাসিয়োনাল ইন্দোনেসিয়া (PNI)—জাতীয়তাবাদী দল, যার লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে দেশকে স্বাধীন করা।
সুকর্ণো সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতেন। তিনি বক্তৃতায় সহজ ভাষা ব্যবহার করতেন, যাতে কৃষক, শ্রমিক এবং শহুরে যুবক-যুবতী সবাই বুঝতে পারে। তার বক্তৃতা ছিল প্রভাবশালী, উত্সাহব্যঞ্জক এবং জনগণের মনে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করত।
ডাচ কর্তৃপক্ষ প্রায়শই তাকে হুমকি ও কারাগারে রাখলেও, সুকর্ণোর অটল দৃঢ়তা জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা জাগিয়ে তোলে।
স্বাধীনতার সংগ্রাম
![]() |
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করছেন সুকর্ণো
১৯৪২-এ জাপানি আগ্রাসনের সময় সুকর্ণো রাজনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হন। তিনি জানতেন যে, স্বাধীনতার আন্দোলনের পথ সহজ নয়। জাপানি শাসনকালে তিনি স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কৌশলগতভাবে জনগণকে সংগঠিত করেন।
২ আগস্ট ১৯৪৫ সালে, তিনি এবং অন্যান্য নেতারা ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৭ আগস্ট ১৯৪৫-এ তিনি দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার ভাষণ এভাবে শুরু হয়:
“আমরা স্বাধীন, কিন্তু আমাদের কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য—একটি শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ এবং সবার কল্যাণে বিশ্বাসী দেশ গঠন।”
রাষ্ট্রপতি হিসেবে নেতৃত্ব ও নীতি
প্রধান রাষ্ট্রপতি হিসেবে সুকর্ণো দেশকে নতুন সংবিধান, অর্থনীতি ও শিক্ষানীতি প্রদান করেন। তার লক্ষ্য ছিল একটি “একজাতীয়, স্বাধীন এবং আধুনিক” ইন্দোনেশিয়া।
তার প্রচলিত নীতি সমূহ:
পঞ্চপ্রকরণ নীতি (Pancasila):
ধর্ম, মানবাধিকার, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়ের মূলনীতি
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা:
গ্রামীণ জনগণ শিক্ষিত ও সুস্থ হয়
অবকাঠামো উন্নয়ন:
রাস্তা, সেতু, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ
জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা:
ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা
কিছু নীতি সমালোচিত হলেও, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার সংযোগ তাকে জনপ্রিয় রাখে। তিনি বিশ্বাস করতেন—সত্যিকারের নেতৃত্ব শক্তিতে নয়, জনগণের কল্যাণে প্রমাণ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক ভূমিকা
সুকর্ণো ছিলেন এশিয়ান-আফ্রিকান সংহতির প্রবক্তা। তিনি বান্ডুং সম্মেলন (Bandung Conference, 1955)–এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন, যা আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করে।
তিনি শান্তি, ন্যায় ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার পক্ষে ছিলেন। পশ্চিমা দেশ এবং সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে সমঝোতা স্থাপন করতে তিনি কৌশলী কূটনীতিকের ভূমিকা পালন করেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও উত্তরাধিকার
![]() |
হজ্জব্রত পালনে সুকর্নো |
সুকর্ণো ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনে বিনয়ী ও পরিশ্রমী। রাষ্ট্রপতি হলেও তার জীবনযাপন ছিল সরল। তিনি বলতেন:
“জাতির পিতা হওয়া মানে নয়, মানুষের কল্যাণে কাজ করা।”
১৯৭০ সালে তার স্বাস্থ্যহীনতার কারণে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ১৯৭০ সালের পরে তিনি নীরব থাকলেও, ইন্দোনেশিয়ার জনগণ তাকে শ্রদ্ধা করে ‘জাতির পিতা’ নামে স্মরণ করে।
উল্লেখযোগ্য উক্তি
“স্বাধীনতা শুধু একটি শব্দ নয়; এটি আমাদের কাজ, আমাদের ইতিহাস এবং আমাদের ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।”
“শক্তি জনগণের কল্যাণে প্রমাণ করতে হয়, ক্ষমতায় নয়।”
সুকর্ণোর পতন ও সমালোচনা
১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সালের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। কমিউনিস্ট বিদ্রোহের অভিযোগ, সামরিক অসন্তোষ এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা একত্রে সুকর্ণোর জনপ্রিয়তাকে চ্যালেঞ্জ করে। এই সময়ে সেনাপ্রধান সুহার্তো ধীরে ধীরে প্রভাব বাড়িয়ে দেন এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সুকর্ণোর এই পতন তার রাজনৈতিক জীবনের এক বেদনাদায়ক অধ্যায় হলেও, তার পূর্বের সংগ্রাম ও অবদানকে মুছে দিতে পারেনি।
স্মৃতিসৌধ ও উত্তরাধিকার
আজকের ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্ণোর নাম গভীর শ্রদ্ধায় উচ্চারিত হয়। জাকার্তার Soekarno–Hatta International Airport, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সড়ক, মূর্তি ও স্মৃতিসৌধ তার উত্তরাধিকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলো শুধু স্মৃতিচিহ্ন নয়, বরং প্রমাণ করে যে তিনি ইন্দোনেশিয়ার জনগণের হৃদয়ের মনিকোঠায় আজও টিঁকে আছেন।
আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
সুকর্ণোর প্রণীত পঞ্চপ্রকরণ (Pancasila) আজও ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি। ধর্ম, মানবতা, জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের এই পাঁচ মূলনীতি সমকালীন ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতি ও সমাজে শক্তিশালীভাবে প্রাসঙ্গিক। ভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনমেলায় ঐক্য রক্ষার দর্শন আজও জাতির পথপ্রদর্শক।
উপসংহার
সুকর্ণো কেবল একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক দূরদর্শী বিপ্লবী, যিনি জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার জীবন আমাদের শেখায়, নেতৃত্ব মানে কেবল ক্ষমতার আসনে বসা নয়, বরং মানুষের মধ্যে আশা জাগানো এবং জাতিকে ঐক্যের পথে পরিচালিত করা।
আজও ইন্দোনেশিয়ার জনগণ তাকে ভালোবেসে ডাকে “বাপাক প্রোক্লামাসি”—স্বাধীনতার জনক। তার আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ইন্দোনেশিয়ার নয়, গোটা এশিয়া-আফ্রিকার ইতিহাসে অনন্ত প্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন—“স্বাধীনতা এক দিনের বিজয় নয়; এটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান এক অনন্ত যাত্রা।”
Comments
Post a Comment