মিশরের গণতন্ত্রের অপূর্ণ যাত্রা: কেন তা স্থায়ী হলো না?


প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি

        

কায়রোর তহরির স্কোয়ার—যেখানে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ একসাথে উচ্চারণ করেছিল তিনটি শব্দ—“রুটি, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার।” মনে হয়েছিল শতাব্দীর পুরনো স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আরব বসন্ত যেন মিশরের ইতিহাসে নতুন ভোরের সূচনা করেছিল। কিন্তু ইতিহাস বড়ই নির্মম। ভোরের আলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল গহীন  অন্ধকারে। সামরিক বাহিনীর বুটের শব্দ আবার ফিরে এলো, আর গণতন্ত্র রয়ে গেল কেবল স্মৃতির পাতায়।

এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব—

1. মিশরে গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।

2. আরব বসন্ত এবং মিশরের গণতান্ত্রিক উত্তরণ।

3. কেন মিশরে গণতন্ত্র স্থায়ী হয়নি—সামরিক আধিপত্য, রাজনৈতিক বিভাজন, নাগরিক সমাজের দুর্বলতা, অর্থনৈতিক সংকট, এবং আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির প্রভাব।

4. তুলনায় ইন্দোনেশিয়ার সাফল্য: কীভাবে তারা সংকট থেকে বেরিয়ে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

5. উপসংহার: মিশরের অভিজ্ঞতা আমাদের কী শিক্ষা দেয়

🇮🇩🇮🇩 ১. মিশরের গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মিশর একসময় সভ্যতার আঁতুরঘর ছিল। নীলনদের তীরে গড়ে ওঠা সমাজ বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাষ্ট্রনীতি—সবকিছুতেই রেখে গেছে অমর ছাপ। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে মিশরের রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল সামরিকতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের এক দীর্ঘ কাহিনি।

১৯৫২ সালে গামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে রাজতন্ত্রের পতনের পর দেশটি সামরিক শাসনেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। নাসের, সাদাত, মুবারক—প্রায় ছয় দশক ধরে রাষ্ট্রপতির আসন ছিল সেনানায়ক বা সামরিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা নেতাদের হাতে। যদিও মাঝে মাঝে নির্বাচনের আয়োজন হতো, কিন্তু সেগুলো ছিল নিছক প্রহসন। গণতন্ত্র তাই মিশরে ছিল কেবলই অধরা।



মিশরে আরব্য বসন্তের ডেউ, ২০১১ 

🔹 ২. আরব বসন্ত এবং গণতন্ত্রের স্বপ্ন

২০১১ সালের জানুয়ারিতে তিউনিসিয়ার বিপ্লবের ঢেউ পৌঁছে যায় মিশরে। তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক—সবাই নেমে আসে রাস্তায়। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে—“মুবারককে বিদায় দাও।” ১৮ দিনের আন্দোলনের পর অবশেষে ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে।

মিশর তখন বিশ্বের চোখে আশার প্রদীপ। মনে হয়েছিল, আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এই দেশে গণতন্ত্র অবশেষে জায়গা করে নেবে। ২০১২ সালে দেশ প্রথমবারের মতো তুলনামূলকভাবে অবাধ নির্বাচনে যায়। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

কিন্তু এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি । মাত্র এক বছরের মধ্যেই ২০১৩ সালের জুলাইতে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। আবারও সেনাবাহিনীর বুটের শব্দ গ্রাস করে নেয় গণতন্ত্রের সব আশা।

🇮🇩🇮🇩 ৩. কেন মিশরে গণতন্ত্র স্থায়ী হয়নি?

ক) সামরিক বাহিনীর শক্তিশালী  ভূমিকা 

মিশরের সেনা শুধু নিরাপত্তা বাহিনী নয় রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে যেমন  অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক   স্তরে তাদের আধিপত্য রয়েছে। রাষ্ট্র বাজেটের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে, ব্যবসা থেকে শুরু করে হাউজিং, কৃষি, রিয়েল এস্টেট—সেনা ব্যাপকভাবে জড়িত । ফলে গণতন্ত্রকে তারা হুমকি হিসেবে দেখেছে।

২০১৩ সালের অভ্যুত্থান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

খ) রাজনৈতিক বিভাজন ও ঐক্যের অভাব

গণতন্ত্রের জন্য ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন প্রয়োজন।গণতন্ত্রের পথে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে,কাঁধে কাঁধ  মিলিয়ে হাঁটতে হয় । কিন্তু মিশরে তা হয়নি।

মুসলিম ব্রাদারহুড বনাম ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থী গোষ্ঠী,একে অপরের প্রবল প্রতিপক্ষ মনে করত। সম্মিলিত শক্তির পরিবর্তে জন্ম নিল বিভাজন। এমন দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে “উদ্ধারকর্তা” হিসেবে ফিরে আসতে সুযোগ দেয়।

মুরসির শাসনে অনেক ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক আশঙ্কা করেছিলেন ইসলামপন্থী একনায়কতন্ত্র গড়ে উঠবে। এ দ্বন্দ্ব গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়।

🚹🚹গ) নাগরিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দুর্বলতা

ইন্দোনেশিয়ায় Muhammadiyah ও Nahdlatul Ulama-এর মতো শক্তিশালী ধর্মীয় সংগঠন গণতন্ত্রে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে—কিন্তু মিশরে এ রকম কোনো সংগঠন ছিল না। ধর্মীয় সংগঠনগুলো বরং রাজনীতির ঘাঁটিতে বিভাজন সৃষ্টি করেছিল। তারা ছিল হয়ে চরম ইসলামপন্থী নয়তো রাষ্ট্রবিরোধী। এতে গণতন্ত্রের পক্ষে  জনগণের মধ্যে শক্ত অবস্থান  তৈরি হয়নি ।

ঘ) অর্থনৈতিক সংকট ও জনগণের হতাশা

গণতন্ত্র তখনই টিকে থাকে যখন মানুষ সমাজ-অর্থনীতিতে উন্নয়ন/স্থিতিশীলতা অনুভব করে। মিশরে বিপ্লবের পরেও প্রকৃত অর্থনৈতিক সংস্কার হয়েছে কম—দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, বেকারত্ব, হতাশা, দুর্নীতির উদ্ভব—এসব মৌলিক সমস্যা অগোছাল থেকে যায়।ফলে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা দ্রুত কমতে থাকে। 

ঙ) আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি

মিশর মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত কেন্দ্র। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ বহু শক্তি সেখানে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়। ফলে যখন সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটায়, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর বিরোধিতা ছিল দুর্বল। বরং অনেক দেশ সেনাদের সমর্থন দেয়।  সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব উভয়ই সেনাবাহিনীর পক্ষে ছিল, আর যুক্তরাষ্ট্র তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাস্তববাদের স্বার্থে গণতন্ত্রের চেয়ে নিরাপত্তাকে বাড়তি অগ্রাধিকার দিয়েছে ।এতে গণতন্ত্র আরও অসহায় হয়ে পড়ে। 

         মিশরে মুরসি বিরোধী বিক্ষোভ,২০১২ 

চ) সাংবিধান ও আইন প্রণয়নে  কাঠামোগত দূর্বলতা 

২০১১–১২ সালের সময়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন হয়, তবে তা আধুনিক গণতান্ত্রিক কাঠামো হিসেবে দৃঢ় হয়নি। কেন্দ্রীয় নির্বাহী শাসনের আধিপত্য, বিচার ও আইন প্রণয়নে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ—এসব একতা বাদ দিয়ে নতুন কাঠামো তৈরির সুযোগ হয়নি ।

ছ) নির্বাচনে আয়োজনে বিভেদ, অনৈক্য  ও অবিশ্বাস

নির্বাচন স্বয়ং democratic transition-এর অন্যতম হাতিয়ার, কিন্তু মিশরে নির্বাচনের সংখ্যা বাড়লেও তা বিভেদকে প্রকট করেছিল। নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটার বিভক্ত হয়েছিল, আর সেনা ও পুরনো প্রতিপক্ষরা উত্তরণ বন্ধ করেছিল ।

🔹 ৪. ইন্দোনেশিয়া কেন সফল হলো?

একই সময়ে ইন্দোনেশিয়া সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে সফল উদাহরণ তৈরি করেছে।

ধর্মীয় সংগঠনের ভূমিকা:

 মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সেখানে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো গণতন্ত্রের সঙ্গে সমন্বয় করেছে।যা মিশরে ছিল পরিপূর্ণভাবে অনুপস্থিত। 

অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি:

 ইসলামী দলগুলো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশ নিয়েছে, কিন্তু তারা একক আধিপত্য বিস্তার করেনি।

নাগরিক সমাজের শক্তি:

 ছাত্র আন্দোলন, মিডিয়া, এনজিও—সবাই গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করেছে।

অর্থনৈতিক সংস্কার: 

বিপর্যয় থেকে ধীরে ধীরে দেশ উন্নতির দিকে এগিয়েছে।

এই কারণে ইন্দোনেশিয়া গণতন্ত্রকে স্থায়ী করতে সক্ষম হয়েছে, অথচ মিশর পিছিয়ে পড়েছে।

সামরিক বিষয়ক নিয়ন্ত্রণ

সুহার্তোর পতনের পর ইন্দোনেশিয়া সেনাকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে আলাদা করতে সক্ষম হয়—গণতন্ত্রের জন্য সেটাই গুরুত্বপূর্ণ শুরু ।

 সংবিধান সংস্কার এবং বিচারব্যবস্থা গঠনের অগ্রগতি

সুহার্তো পতনের পর সংবিধানে পরিবর্তন এনে দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি সীমাবদ্ধতা, বিচার প্রতিষ্ঠা, কনস্টিটিউশনাল কোর্ট ও দুর্নীতি দমন কমিশন স্থাপনা—এসব গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে ।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ 

“Big Bang” ডেসেন্ট্রালাইজেশন এবং স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল—যদিও এতে কিছু জায়গায় প্রশাসনিক বিভ্রাট ও দুর্নীতি দেখা গেলেও মূলভাবে গণতন্ত্রকে আরও টেকসই করেছে ।

 সংসদীয় দল ও রাজনৈতিক স্থায়ীত্ব

নতুন রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত ম্লান হলেও Golkar, PDIP, PKB, PAN এর মতো দল দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পেরেছে—এতে রাজনৈতিক স্থায়ীত্ব এবং ভোটব্যাংক গড়বার সুযোগ আসেছে ।

 মিডিয়া ও নাগরিক অধিকার বিস্তার

Reformasi পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার স্বাধীনতা, মিডিয়ার উন্মুক্ততা এবং নাগরিক অধিকারকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ।

🔹 ৫. উপসংহার

মিশরের গণতন্ত্রের যাত্রা এক অপূর্ণ কবিতা। যা শুরু হয়েছিল আশার গান দিয়ে, শেষ হয়েছে হতাশার অশ্রুতে। ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে—

কেবল শাসক পরিবর্তন নয়, বরং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, ঐক্যবদ্ধ সমাজ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ছাড়া গণতন্ত্র বাঁচে না।

যেখানে  কাঠামোগত দুর্বলতা, বিভাজন, আর সামরিক আধিপত্য বিশেষ করে সামরিক বাহিনী যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি  স্তরে শক্তিশালীভাবে প্রভাব বিস্তার করে  তাহলে  রাজনীতির ময়দানে গণতন্ত্রকে টিকে থাকা কঠিন

আর ইন্দোনেশিয়া দেখিয়েছে, সংকটের মধ্যেও যদি রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, নাগরিক সমাজের শক্তি, এবং অর্থনৈতিক সংস্কার একসাথে কাজ করে—তাহলে গণতন্ত্র টিকে যায়।

তাই প্রশ্ন থেকে যায়—মিশর আবার কি কখনো গণতন্ত্রকে ফিরে পাবে? সেই লড়াই এবং তার জয় কি শুধু ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে? নাকি সত্যিই বাস্তবে কোনদিন ফিরবে?  সময়ই হয়তো বলে দিবে। 



























Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প