জুলিয়াস নিয়্যারারে: তানজানিয়ার ‘মওয়ালিমু’ – এক স্বপ্নবাজ শিক্ষক থেকে জাতির পিতা
![]() |
জাতির পিতা জুলিয়াস কামবারাগে নিয়্যারারে |
দিগন্তজোড়া সাভানায় ভোরের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ছে, গাছে গাছে পাখির কূজন। গ্রামীণ পথ ধরে হেঁটে চলেছেন এক তরুণ—হাতে বই, চোখে অদ্ভুত এক দীপ্তি। তার পদক্ষেপ শুধু স্কুলের দিকে নয়, যেন ইতিহাসের দিকে এগিয়ে চলা। তিনি জানেন না, একদিন তাকে ‘মওয়ালিমু’—শিক্ষক—হিসেবে নয়, বরং এক জাতির পিতা হিসেবেও স্মরণ করা হবে। এই মানুষটির নাম জুলিয়াস কামবারাগে নিয়্যারারে।
জুলিয়াস নিয়্যারারে ছিলেন এমন এক নেতা, যিনি ক্ষমতার মোহে নয়, বরং মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতেন। শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীনতার আন্দোলন, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উজামা সমাজতন্ত্র—যার কেন্দ্রে ছিল ঐক্য, সমতা ও আত্মনির্ভরতা। আফ্রিকার স্বাধীনতার ইতিহাসে তার নাম উচ্চারিত হয় এক বিনয়ী বিপ্লবীর মতো, যিনি নিজের জাতিকে স্বাধীনতার পথে নেতৃত্ব দিয়ে আফ্রিকার ঐক্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
নিয়্যারারে ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় অনন্য ছিলেন। প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে যেতেন। মিশনারি স্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি প্রথম ইংরেজি শেখেন এবং দ্রুতই ক্লাসের সেরা শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি উগান্ডার মাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন—যা তখন পূর্ব আফ্রিকার অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
পরবর্তীতে স্কলারশিপ পেয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে যান। সেই সময় আফ্রিকার খুব কম শিক্ষার্থীই ইউরোপে পড়াশোনার সুযোগ পেতেন। এডিনবরার দিনগুলো তাকে গভীর রাজনৈতিক চেতনা দেয়—তিনি পড়তে থাকেন মহাত্মা গান্ধী, কার্ল মার্ক্স, এবং আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী লেখকদের রচনা।
শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ
![]() |
দেশে ফিরে নিয়্যারারে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দেন। শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, বরং জীবনদর্শনের অনুপ্রেরণাদাতা। এখান থেকেই তার ‘মওয়ালিমু’ নামটি জনপ্রিয় হয়। কিন্তু শ্রেণিকক্ষের বাইরের সমাজ তাকে ব্যথিত করত—দারিদ্র্য, বেকারত্ব, এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অবিচার।
১৯৫৪ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন টাঙ্গানইকা আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (TANU)। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বাধীনতা। TANU-র সভায় নিয়্যারারের ভাষণ ছিল সহজবোধ্য কিন্তু হৃদয়স্পর্শী—গ্রামীণ কৃষক, শহুরে শ্রমিক, তরুণ শিক্ষার্থী—সবাই তার কথায় নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পেত।
স্বাধীনতার পথে সংগ্রাম
১৯৫০-এর দশকে আফ্রিকার বহু দেশেই স্বাধীনতার আন্দোলন তীব্র হচ্ছিল। নিয়্যারারে ছিলেন অহিংস আন্দোলনের পক্ষে, মহাত্মা গান্ধীর দর্শনে অনুপ্রাণিত। তিনি ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আলোচনায় দক্ষতার পরিচয় দেন এবং ধীরে ধীরে টাঙ্গানইকার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
১৯৬১ সালে টাঙ্গানইকা স্বাধীনতা লাভ করে, নিয়্যারারে হন প্রথম প্রধানমন্ত্রী। ১৯৬৪ সালে জানজিবারের সঙ্গে একীভূত হয়ে তানজানিয়া প্রজাতন্ত্র গঠিত হয় এবং নিয়্যারারে হন প্রথম রাষ্ট্রপতি।
তার শপথ গ্রহণের সময় বলা এক লাইন আজও ইতিহাসে অমর—
“আমরা স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু আমাদের কাজ এখনো শুরু।”
উজামা সমাজতন্ত্র – স্বপ্ন ও বাস্তবতা
নিয়্যারারের রাজনৈতিক দর্শনের মূল ছিল উজামা—সোয়াহিলি ভাষায় যার অর্থ ‘ভ্রাতৃত্ব’ বা ‘সম্প্রদায়’। এর লক্ষ্য ছিল—
সামাজিক সমতা
গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন
আত্মনির্ভরতা
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসার
তিনি শুরু করেন ‘ভিলেজাইজেশন’ প্রোগ্রাম—ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন গ্রামকে বড় সমবায় গ্রামে রূপান্তর করা, যাতে মানুষ যৌথভাবে কৃষিকাজ করতে পারে এবং সরকারি সেবা পায়।
প্রথমদিকে এই নীতি আন্তর্জাতিক প্রশংসা পায়, কিন্তু বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ আসে—কৃষি উৎপাদন প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি, আর্থিক সংকট দেখা দেয়। তবুও, উজামা তানজানিয়ার সমাজে গভীর ঐক্য ও জাতিগত সম্প্রীতি তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক ভূমিকা ও আফ্রিকান ঐক্য
![]() |
নিয়্যারারে কেবল তানজানিয়ার নয়, পুরো আফ্রিকার নেতা ছিলেন। তিনি আফ্রিকান ইউনিটি অর্গানাইজেশনের (OAU) প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক। তার দেশ জিম্বাবুয়ে, মোজাম্বিক, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিত।
তিনি বিশ্বাস করতেন—আফ্রিকার মুক্তি কেবল জাতীয় নয়, বরং মহাদেশীয় একতা ছাড়া সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি ছিলেন শান্তি ও ন্যায়বিচারের কণ্ঠস্বর।
সমালোচনা ও উত্তরাধিকার
নিয়্যারারের উজামা নীতিকে অনেক অর্থনীতিবিদ অকার্যকর বলে সমালোচনা করেন। কিন্তু কেউই তার সততা ও আত্মত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। ১৯৮৫ সালে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন—যা আফ্রিকার রাজনীতিতে বিরল ঘটনা।
১৯৯৯ সালে তার মৃত্যু হয়। তানজানিয়ায় আজও তিনি ‘বাবা ওয়া তাইফা’—জাতির পিতা—হিসেবে শ্রদ্ধেয়। তার নামে সড়ক, বিশ্ববিদ্যালয়, ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য উক্তি
“শিক্ষা মানে স্বাধীনতার প্রস্তুতি।”
“ঐক্য ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।”
Comments
Post a Comment