এমির আব্দেল কাদের: মরুর সিংহ, শান্তির কবি
![]() |
"যুদ্ধের ময়দানে তিনি ছিলেন তলোয়ারের ঝলক, শান্তির প্রান্তরে ছিলেন করুণার জলধারা। আলজেরিয়ার মরুভূমি তাঁকে দিয়েছে সাহস, আর আকাশ দিয়েছে বিশ্বাস—সেই মানুষই এমির আব্দেল কাদের।" |
জন্ম ও শৈশব
১৮০৮ সালের এক শীতল ভোর। আলজেরিয়ার গুটনা গ্রাম তখনও ঘুমের আস্তরণে ঢাকা। পূর্ব দিকের আকাশে রঙিন রেখা আঁকতে শুরু করেছে সূর্য, আর দূরে আটলাস পর্বতমালার চূড়াগুলো হালকা কুয়াশায় মোড়ানো। মরুভূমির বাতাসে ভেসে আসছে তাজা খেজুর পাতার গন্ধ, আর কোনো কোনো উটের ঘণ্টাধ্বনি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে।
সেই ভোরেই, একটি মাটির ঘরের ভেতর এক শিশুর প্রথম কান্না ভেঙে দিল নিস্তব্ধতা। পিতা—শায়খ মহিউদ্দিন আল-হাসানি, দরবারের সুফি গুরু—চোখে জল নিয়ে তাকালেন ছোট্ট নবজাতকের দিকে। তিনি মৃদু স্বরে ফিসফিস করে বললেন:“
"এ আল্লাহ, এই সন্তানকে জ্ঞান ও ন্যায়ের আলোয় ভরিয়ে দাও।”
শিশুর মা, জাহরা, ক্লান্ত হলেও চোখে রাখলেন এক আশ্চর্য উজ্জ্বলতা। বাইরের বাতাসে হালকা ঠান্ডা, কিন্তু ঘরের ভেতর কুরআনের আয়াতের মৃদু ধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছে উষ্ণতা।
পিতা তাঁর কোলের শিশুটির নাম রাখলেন—আব্দুল কাদের। নামটির মধ্যে ছিল আভিজাত্য ও দায়িত্ব; যেন এক ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।
শৈশবের আকাশে ছোট্ট কাদের বড় হচ্ছিলেন এমন এক পরিবেশে, যেখানে জ্ঞান ও ঈমান হাত ধরাধরি করে চলে। দিন শুরু হতো ফজরের নামাজ দিয়ে, তারপর মক্তবে যাওয়া। তিনি অল্প বয়সেই কুরআন মুখস্থ করতে শুরু করলেন।
একদিন, মাত্র আট বছর বয়সে, তাঁর পিতা তাঁকে ডাকলেন:
“কাদের, তুমি আজ আমাকে সূরা আল-আসর শোনাবে।”
ছেলেটি সুর করে পড়তে লাগল:
"ওয়াল আসরি, ইন্নাল ইনসানা লাফি খুস্র..."
শেষ করার পর পিতা বললেন:
— “শুধু মুখস্থ করলেই হবে না, এর অর্থ বোঝো। সময় হল মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ, আর অন্যদের জন্য কল্যাণকর জীবনই শ্রেষ্ঠ।”
গ্রামের প্রবীণদের কাছে শোনেন মরুর যোদ্ধাদের সাহস ও সুফি সাধকদের দয়ার কাহিনি। একদিন এক প্রবীণ বললেন:
“সাহসী হতে হলে শুধু তলোয়ার নয়, হৃদয়ও শক্ত হতে হবে। আর ন্যায়বান হতে হলে, হৃদয়কে কোমল হতে হবে।”
পড়াশোনা
কৈশোরে কাদেরের কপালে জ্ঞানের আলো, চোখে অনুসন্ধিৎসার দীপ্তি। পিতা তাঁকে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নয়, অঙ্ক, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, আরবি সাহিত্য শেখালেন।
১৮২৫ সালে বসন্তের শুরুর প্রভাতে শায়খ মহিউদ্দিন বললেন
“কাদের, এবার তুমি আমার সঙ্গে হজে যাবে।”
উটে চড়ে শুরু হলো যাত্রা। কনস্টান্টিন, তিউনিস, জাহাজে আলেকজান্দ্রিয়া, তারপর কায়রো। প্রতিটি শহরের গন্ধ, রঙ, শব্দ কাদেরের মনে অমলিন হয়ে রইল।
মক্কায় পৌঁছে তিনি কাবার দিকে তাকিয়ে বললেন—
“এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম, এখানে হাঁটতেন নবী মুহাম্মদ (সা.)…”
হজের রুকনগুলো শেষ করার সময় মনে হচ্ছিল, তিনি নিজের ভেতরের অহংকার, ভীতি, অজ্ঞানতার পর্দা সরিয়ে ফেলছেন।
এরপর দামেস্কে গিয়ে সুফি দরবারের ধ্যান ও আলোচনা শুনে তাঁর ভিতরে জ্ঞান ও মানবতার বীজ বপিত হলো। বাগদাদের দরবার থেকে তিনি শিখলেন—মানুষ ভিন্ন হলেও একই আল্লাহর বান্দা।
![]() |
যুদ্ধের ডাক
১৮৩০ সালের গ্রীষ্মে ফরাসি নৌবহর আলজেরিয়ার উপকূলে এসে পড়ল। মরুভূমির বাতাসে বদলের গন্ধ।
এক সন্ধ্যায় উপজাতিদের জরুরি সভায় আব্দেল কাদের বললেন—
“ফরাসিরা শুধু জমি দখল করছে না, তারা আমাদের আত্মাকে বিনষ্ট করতে চায়। আমরা কি দাঁড়িয়ে দেখব?”
এক প্রবীণ উত্তেজিত হয়ে বলল,
“এমির, তুমি আমাদের নেতৃত্বে এসো। তোমার তলোয়ার ও তোমার বুদ্ধি, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।”
কাদের বললেন,
“আমি লড়াই করব শুধু তলোয়ার দিয়ে নয়, বিশ্বাস, ন্যায় ও ঐক্য দিয়ে। আলজেরিয়া মুক্ত হবে।”
তিনি নির্বাচিত হলেন এমির আব্দেল কাদের—মরুর সিংহ।
![]() |
মরুর সিংহ উপাধি
মরুর বালুকায় সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এমিরের চোখে দীপ্তি জ্বলে উঠল—যে দীপ্তি ন্যায়বিচারের।
একদিন সৈন্যরা জিজ্ঞেস করল,
“আমরা কেন লড়াই করছি?”
তিনি বললেন,
“আমাদের লড়াই জমির নয়, আত্মার, ধর্মের, মানুষের মর্যাদার জন্য। লড়াই হবে করুণার।”
তিনি গেরিলা কৌশল নিয়ে ফরাসি সৈন্যদের হতবাক করলেন।
১৮৩৫ সালের ম্যাক্তা যুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়লাভের পর এমির সৈন্যদের সঙ্গে বন্দি ও আহত ফরাসিদের প্রতি করুণা দেখালেন।
একবার একটি ছোট গ্রামে আগুন লাগলে তিনি কাঁদতে থাকা বৃদ্ধাকে বললেন—
“আমাদের লড়াই মানুষের জীবন রক্ষার জন্য।”
![]() |
স্মালা — এক চলমান নগরী ও আব্দেল কাদের
স্মালা ছিল মরুভূমির বুকে একটি চলন্ত নগরী—মসজিদ, বাজার, স্কুল, লাইব্রেরি সহ।
এক সকালে এমির এক শিশুকে বললেন—
“সবকিছু পরিবর্তনশীল, যেমন স্মালা। তবে বিশ্বাস ও ঐক্য চিরস্থায়ী।”
১৮৪৩ সালের ১৬ মে ফরাসি সেনারা হঠাৎ আক্রমণ করল স্মালায়।
স্মালা ধ্বংস হলো, বহু মানুষ বন্দি হলো। কিন্তু এমির বললেন
“স্মালা ভেঙে যেতে পারে, তবে আমাদের বিশ্বাস ভাঙবে না।”
বন্দিত্বের মরুপ্রাচীর
১৮৪৭ সালে আত্মসমর্পণ করে এমির বন্দি হন ফরাসিদের হাতে।
ফ্রান্সের দুর্গে বন্দিত্বের জীবন কাটিয়ে তিনি মানবতার চিত্র আঁকলেন।
এক ফরাসি কর্মকর্তা বললেন,
“আপনি যোদ্ধা নন, আদর্শ।”
তিনি বললেন,
“আমার সংগ্রাম চলছে মানবতার পথে।”
রাতের নিরবতায় ভাবতেন—কিভাবে আলজেরিয়ার মানুষ মুক্তি পাবে?
দামেস্কের রক্ষক আব্দুল কাদের
১৮৫২ সালে মুক্ত হয়ে দামেস্কে শান্ত জীবন শুরু করলেন।
তিনি দরবার গড়ে তুলে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদির জন্য হয়ে উঠলেন রক্ষক।
১৮৬০ সালের দামেস্ক দাঙ্গায় হাজারো খ্রিস্টানকে আশ্রয় দিলেন।
বললেন,
“আমার প্রাণ হোক শত্রুর হাতে, কিন্তু নিরপরাধ কেউ ক্ষতি পাবে না।”
বিশ্বজুড়ে ‘মরুর সিংহ’ হিসেবে সম্মানিত হলেন।
![]() |
উপসংহার
২৬ মে ১৮৮৩ সালে শান্তিপূর্ণ মৃত্যু দিলেন।
জানতেন লড়াই শেষ নয়, আদর্শ চিরন্তন।
১৯৬৫ সালে আলজেরিয়া তাঁর দেহাবশেষ ফিরিয়ে নিয়ে তাঁকে জাতির নায়ক ঘোষণা করল।
আজও তাঁর নাম উচ্চারণে মরুর বাতাসে জেগে ওঠে সাহস, ন্যায় ও মানবতার সুর।
Comments
Post a Comment