বাংলাদেশের ম্যানহোল দুর্ঘটনা: অবহেলা, মৃত্যু এবং দায়দায়িত্বের সংকট


ভূমিকা

একটি শহর যখন নিজের বাসিন্দাদের প্রতি নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সে শহর জীবন্ত মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় খোলা ও অপ্রতিষ্ঠিত ম্যানহোলের চিত্র এ কথার উজ্জ্বল প্রমাণ। প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে এমন দুর্ঘটনা, যেখানে মানুষের জীবন যেন ব্যবহৃত হয় একটি অবহেলিত নান্দনিকতার বলি হিসেবে।

ঢাকা, টঙ্গী, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটসহ বড় বড় শহরের রাস্তায় পড়ে থাকা এই অচিহ্নিত মৃত্যুর ফাঁদগুলো জনজীবনের সাথে আজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো, এসব দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে প্রশাসনের অবহেলা ও দায় এড়ানোর সংস্কৃতি।

এই লেখায় আমরা বাংলাদেশের ম্যানহোল দুর্ঘটনার ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরব, দেখাবো কোথায় কোথায় সরকারি অব্যবস্থাপনা চলছে, কী নাটক সাজানো হচ্ছে, এবং উন্নত দেশের আধুনিক ব্যবস্থা থেকে কি শিক্ষা নেয়া যায় তা আলোচনা করব।

১. ম্যানহোল দুর্ঘটনার ভয়াবহ ঘটনা ও নামকরা উদাহরণ

১.১ টঙ্গীর ফাতেমা বেগম: ৩৬ ঘণ্টা মৃত্যুর গ্লানি

২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে টঙ্গী শহরের এক ভেজা রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন ফাতেমা বেগম, ৪২ বছর বয়সী এক গৃহিণী। হঠাৎ তার পা পড়ে যায় এক খোলা ম্যানহোলে। আশপাশে কোনও সতর্কতা চিহ্ন ছিল না, কোনো বাঁশ বা বেড়াও ছিল না। তিনি নিঃশব্দে বর্জ্য পানির মধ্যে হারিয়ে যান।

লোকজন জানায়, ৩৬ ঘণ্টা পরে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ৩৬ ঘণ্টা! এতো দীর্ঘ সময় কেউ তার সন্ধান বা উদ্ধার কাজ শুরু করেনি। টঙ্গীর সাধারণ মানুষ প্রশাসনের উপর অসহায়। স্থানীয় সিটি কর্পোরেশন বা পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষ কেউ দায় নেয়নি বা খোঁজখবর নেয়নি।

এই দুর্ঘটনা শুধু একজন নারীর মৃত্যুই নয়, এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার শাপ।

১.২ শিশু জিহাদের মৃত্যু: ২০১৪ সালের করুণ গল্প

ঢাকার রেললাইনের পাশের এক খোলা পাইপে পড়ে যায় চার বছরের শিশু জিহাদ। প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পরে উদ্ধার করা হয়, কিন্তু বাঁচানো যায়নি।

এ ঘটনায় সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় ছিল তার বাবা-মায়ের ওপর রাজনৈতিক চাপ। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা তাদের ধরে নিয়ে যায়, জিজ্ঞাসাবাদ করে সন্দেহের চোখে দেখে। সরকার দাবি করে, এটি ছিল বিরোধীদলের ষড়যন্ত্রের অংশ, যেখানে তারা সরকারকে অসংলগ্ন ও অদক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করছিল।

অপরাধী কারা? শিশু জিহাদ নাকি অসহায় বাবা-মা, নাকি এক অসম্মানজনক রাজনৈতিক নাটকের শিকার?  এই প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে।



                           
                    ঢাকা শহরের ম্যানহোলের চিত্র

১.৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী: অদৃশ্য গর্তের ভয়

২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্রী রাস্তা পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ পথের নিচে অব্যবস্থাপনার কারণে একটি গর্তের মধ্যে পা পড়ে যায়। এতে তার পা ভেঙে গুরুতর আহত হন।

পাঠ্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত এ তরুণী চিকিৎসার জন্য দীর্ঘদিন ধাক্কা খেয়েছেন, কারণ দুর্ঘটনার দায় কেউ নিতে চায়নি। নগর প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ দুই পক্ষই এই ঘটনার দায় এড়াতে ব্যস্ত ছিল।

১.৪ চট্টগ্রামের বৃষ্টির দিনে এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু

২০১৮ সালে চট্টগ্রামে বৃষ্টির দিন এক শিশু খোলা ম্যানহোলে পড়ে যায়। স্থানীয়রা অনেকবার প্রশাসনকে জানানোর পরেও বরাবরই কোনও পদক্ষেপ হয়নি। শিশুটি ডুবে মারা যায়।

শিশুর পরিবারের আর্তনাদ শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু প্রশাসন থেকে আসেনি কোনও প্রতিক্রিয়া বা সহায়তা।

১.৫ বরিশালের রিকশাচালকের মৃত্যুর গল্প

বরিশালের এক রিকশাচালক ভাঙা ড্রেনের খোলা ম্যানহোলে পড়ে গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এলাকাবাসী বারবার ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা সংস্কারের দাবি জানালেও কাজ হয়নি।

১.৬ অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ম্যানহোল দুর্ঘটনা

কুর্মিটোলার খোলা ম্যানহোলে পড়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু

সাভারে রিকশাচালক ও পথচারীদের প্রায়শই দুর্ঘটনা

রাস্তার কাজ চলাকালীন ঢাকনা খুলে রেখে ফেরানো না হওয়া ঘটনা

২. সরকারি অবহেলা, নাটক ও দায় এড়ানোর সংস্কৃতি

২.১ দীর্ঘ উদ্ধারকাল: দেরিতে বাঁচানো যায়নি অনেক জীবন

ম্যানহোল দুর্ঘটনার প্রতিটি ঘটনায় উদ্ধারের সময় অত্যন্ত দীর্ঘ। সরঞ্জামের অভাব, যথাযথ প্রশিক্ষণহীন উদ্ধারকারী দল, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব মূল কারণ।

অনেক সময় উদ্ধার তৎপরতা শুরুতেই বিলম্বিত হয়। কেউ দায় নিতে চায় না বা তৎপরতা দেখায় না। এই কারণে অনেকে মৃত্যু বরণ করে।

২.২ দায়িত্বের বিভাজন ও জটিলতা

ম্যানহোলগুলো বিভিন্ন দপ্তরের অধীনে থাকে—সিটি কর্পোরেশন, পানি সরবরাহ বিভাগ, রেলওয়ে, সড়ক ও জনপথ বিভাগ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারও দায়িত্ব পরিষ্কার নয়।

এই বিভাজন ও সমন্বয়ের অভাবে কোন ম্যানহোলের দায়িত্ব কার, তা স্পষ্ট না হওয়ায় সমস্যার সমাধান সম্ভব হয় না।

২.৩ রাজনৈতিক নাটক ও বিভ্রান্তি: জিহাদের ঘটনা থেকে শুরু

জিহাদ নিহত হওয়ার পর পরিবারের ওপর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে সরকার বিরোধীদল ও বেসরকারি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে।

সরকার দাবি করে, এটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যেখানে পরিবার ও বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এতে ঘটনাটি জাতীয় মনোযোগ পায়নি, বরং বিভ্রান্তির সৃষ্টিই হয়েছে।

এভাবেই মৃতের প্রতি সম্মান না রেখে রাজনৈতিক নাটকের মাধ্যমে দায় এড়ানোর সংস্কৃতি চালু রয়েছে।

২.৪ তথ্য ও দায় এড়ানোর সংস্কৃতির দুঃস্বপ্ন

অসচ্ছল ও সাধারণ মানুষ যাদের নিরাপত্তার প্রশ্নে কথা বলা যায় না, তারা হয় আহত বা নিহত। কিন্তু দায় নিতে রাজি কেউ নেই। তদন্ত বিলম্বিত হয়, মামলার রেকর্ড হয়, কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কখনো হয় না।

এটি একটি বৃহৎ সামাজিক সমস্যা যার প্রতি সরকারের উদাসীনতা মারাত্মক।

৩. উন্নত দেশের আধুনিক ম্যানহোল নিরাপত্তা ব্যবস্থা

৩.১ যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্মার্ট ম্যানহোল

নিউইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকো, লস এঞ্জেলেসের মতো শহরগুলোতে ম্যানহোল ঢাকনায় সেন্সর বসানো হয়। ঢাকনা খুললেই অ্যালার্ম বাজে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নোটিফিকেশন যায়।

২০১৮ সালে নিউইয়র্কে একটি পোষা কুকুর খোলা ম্যানহোলে পড়ে গেলে দ্রুত উদ্ধার করা হয় এবং মালিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এতে প্রতিটি দুর্ঘটনার দায়বদ্ধতা স্পষ্ট করা হয়েছে।

৩.২ যুক্তরাজ্যের কঠোর আইন

ব্রিটেনে খোলা ম্যানহোলে কেউ পড়লে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট কাউন্সিল দায়ী থাকে ম্যানহোল বন্ধ করার। না করলে মামলা হয়। “Public Safety Liability Act” এ দুর্ঘটনার জন্য প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হয়।

৩.৩ জাপানের উন্নত প্রযুক্তি ও নজরদার

জাপানে প্রতিটি ম্যানহোল নিয়মিত সিসিটিভি মনিটরিংয়ের আওতায় থাকে। ভাঙ্গা ঢাকনা দ্রুত প্রতিস্থাপন করা হয়। দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ক্ষতিকর অবস্থা শনাক্ত হয়।



            সিঙ্গাপুরের আধুনিক ম্যানহোল

৩.৪ সিঙ্গাপুরের নগর পর্যবেক্ষণ

সিঙ্গাপুরের নগর পরিকল্পনাবিদরা ‘Urban Redevelopment Authority’ মাধ্যমে প্রতিটি রাস্তার অবস্থা লাইভ মনিটরিং করে। ম্যানহোলের অবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়।

৩.৫  দক্ষিণ কোরিয়া: স্মার্ট মনিটরিং ও জরুরি সিগন্যাল

সিউলে ম্যানহোল ঢাকনায় অত্যাধুনিক সেন্সর বসানো হয়েছে যা ঢাকনা খোলা মাত্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মোবাইলে তৎক্ষণাৎ নোটিফিকেশন পাঠায়। জরুরি পরিষেবা তড়িৎগতিতে উদ্ধার কাজে লিপ্ত হয়। এছাড়াও, নিয়মিত রুটিন ইন্সপেকশন ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য সজাগ নজরদারি থাকে।

৩.৬  জার্মানি: কঠোর দায়বদ্ধতা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা

জার্মানির স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার খোলা ম্যানহোলের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ করে। দুর্ঘটনায় জড়িত বা অবহেলাকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পূর্ণ ক্ষতিপূরণ বাধ্যতামূলক। এতে দুর্ঘটনার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

৩.৭  কানাডা: জনসাধারণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা

কানাডার বেশ কিছু শহরে নাগরিকরা নিজ এলাকায় ম্যানহোল ও ফুটপাথের অবস্থা রিপোর্ট করতে পারে সরাসরি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। প্রশাসন দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। এভাবে জনমতকে কাজে লাগিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বাড়ানো হয়।

৪. বাংলাদেশের জন্য করণীয়

৪.১ GPS ট্র্যাকড স্মার্ট ম্যানহোল ঢাকনা

বাংলাদেশেও স্মার্ট ঢাকনা বসানোর প্রয়োজন রয়েছে, যেখানে ঢাকনা খোলা মাত্র সিস্টেমকে সতর্কতা দেওয়া হবে।

৪.২ নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা

ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনসহ সব সিটি কর্পোরেশনে স্থায়ী নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৪.৩ জরুরি উদ্ধার রেসপন্স টিম গঠন

নগর এলাকায় উদ্ধার কাজের জন্য প্রশিক্ষিত বিশেষ দল গঠন করা প্রয়োজন যারা ২৪/৭ সময়ের মধ্যে দ্রুত উদ্ধার কাজ করবে।

৪.৪ দায় এড়ানোর সংস্কৃতি ভাঙতে কঠোর আইন

ম্যানহোল দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের দায় এড়ানো সংস্কৃতির অবসান দরকার।

৪.৫ সচেতনতা ও জনগণের ভূমিকা

নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং ম্যানহোলের আশেপাশে সতর্কতা চিহ্ন ও বাঁশের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা উচিত।

উপসংহার

বাংলাদেশের রাস্তাগুলো আজও মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত। ফাতেমা বেগম, শিশু জিহাদ, বরিশালের রিকশাচালক সহ বহু মানুষের জীবন কেবল অবহেলা ও দায় এড়ানোর বলি হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা আর স্থায়ী হতে পারে না।

সরকার, প্রশাসন ও নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। স্মার্ট প্রযুক্তি, আধুনিক পরিকল্পনা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই পরিস্থিতি পরিবর্তন অসম্ভব।

জীবন রক্ষা করার দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, প্রতিটি নাগরিকেরও। তাই এখনই সময় সচেতন হওয়ার, দাবি জানানোর এবং নিরাপদ নগর গড়ার।


পাঠকের জন্য প্রশ্ন

আপনার এলাকায় কতগুলো ম্যানহোল খোলা পড়ে আছে? আপনার মতামত ও অভিজ্ঞতা কমেন্টে জানিয়ে দিন।







Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প