চতুর্থ পর্ব : আগুনের মাঝে দাঁড়িয়ে এক মহীয়সী নারী মেহেরিন চৌধুরীর সাহস ও ত্যাগের গল্পসহ বিশ্বজুড়ে শিক্ষকদের বীরত্বগাথা
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, যখন নিজে জীবন বিপন্ন, তখন অন্যের জীবন বাঁচাতে কারও কি সত্যিই এত সাহস হতে পারে?
একজন নারী, যিনি আগুনের শিখায় নিজেকে জ্বালিয়ে দিলেন, বাঁচালেন ২০ জন শিশুর প্রাণ — তিনি মেহেরিন চৌধুরী।
এই গল্প শুধু আগুনের নয়, মানুষের হৃদয় ছোঁয়ার গল্প ।
২০২৫ সালের ২১ জুলাই, দুপুর ১:১৮। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়নের ১২ মিনিটের মধ্যে ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত মাইল স্টোন কলেজে বিধ্বস্ত হয়। এতে পাইলটসহ কমপক্ষে ৩২ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়।
সেখানে শিক্ষক মেহেরিন চৌধুরী এক মহীয়সী নারী যার বীরত্বে অন্তত ২০ জন ছাত্র বেঁচে যায় অথচ তার নিজের শরীরের অন্তত ৮0 শতাংশ তখন পুড়ে গিয়েছিল। সেই অমর বাতিঘর, যার আলো আজও মানুষকে পথ দেখায়।
মেহেরিন চৌধুরী
সেই দিন দুপুর বেলা, মাইলস্টোন কলেজে ক্লাস চলছিলো শান্তিপূর্ণ ভাবে।
হঠাৎ করেই বিস্ফোরণের শব্দে চারপাশ কেঁপে ওঠে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। ছাত্রছাত্রীরা আতঙ্কে ছুটতে শুরু করে, কেউ চিৎকার করে, কেউ জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।কিন্তু সেই অস্থিরতার মধ্যে এক নারী ছিলেন শান্ত, দৃঢ় ও সাহসী।তিনি ছিলেন মেহেরিন চৌধুরী, এক নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক, যিনি ওই দিন শুধু পাঠদান করছিলেন না—তিনি ছিলেন জীবনদাত্রী।
মেহেরিন একে একে ক্লাসরুম থেকে ছাত্রদের বের করে আনতে লাগলেন। ধোঁয়ার মধ্যেও তার দৃশ্যমান সাহস ছিল দৃষ্টিনন্দন। তার শরীরে আগুন ধরে গিয়েছিল, শরীরের অন্তত ৮0 শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল তিনি ছেলেমেয়েদের একা ছেড়ে যাননি।আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর, শয্যায় শুয়ে তিনি বলেছিলেন,
“ওরা যেন বাঁচে, ওদের বাঁচাতে পারলেই আমার জীবন সফল।”
বিশ্বের সাহসী শিক্ষকদের দৃষ্টান্ত
১. ভিক্টোরিয়া সোটো:
২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের স্যান্ডি হুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বন্দুকধারীর হামলায়, শিক্ষিকা ভিক্টোরিয়া সোটো নিজের জীবন দিয়ে ১৫ জন শিশুকে বাঁচিয়েছিলেন।তিনি ক্লাসরুমের আলমারিতে ছাত্রদের লুকিয়ে দিয়েছিলেন, নিজে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়েন, কিন্তু তার সাহসিকতা শিশুরা আজও জীবিত রাখে।
২. রামেশ্বরী দেবী:
২০১৫ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপ থেকে আটজন শিশুকে উদ্ধার করেন নেপালের শিক্ষিকা রামেশ্বরী দেবী।নিজের দুই পা ভেঙে যাওয়ার পরও তিনি থেমে থাকেননি, নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে যুদ্ধে লড়েছেন।
৩. মুগিশা জ্যাঁ
৪. এলিসন হিল
২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ভয়াবহ ব্রাশফায়ারের সময়, এলিসন হিল নিশ্চিত করেছিলেন কেউ বাসে বাদ না পড়ে।একজন শিক্ষার্থীর জন্য নিজের জুতা খুলে দিয়ে, নিজে আগুনের মাটিতে দৌড়ে বাসে পৌঁছেছেন।
৫. শিমন বেন-আরি
আত্মহত্যা করতে যাওয়া এক ছাত্রের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে, কান্না করে, আলিঙ্গন করে জীবন উপহার দিয়েছেন ইসরাইলের শিমন বেন-আরি।ছাত্রটি পরে বলেছিলেন,
“সে আমাকে আবার বাঁচতে শিখিয়েছে।”
শিক্ষকতা: পেশা নয়, ত্যাগ ও আত্মত্যাগের মহিমা
শিক্ষকতা শুধুমাত্র পড়ানো নয়, এটি হলো মানুষের জীবনকে আলোয় ভরিয়ে দেয়া ।মেহেরিন চৌধুরীর মতো শিক্ষিকারা দেখিয়েছেন, সাহসিকতা, দায়িত্ববোধ এবং নির্ভরযোগ্যতা কীভাবে জীবন রক্ষা করে।
বাংলাদেশের সাহসী নারীদের কাহিনি
হাসিনা বেগম
২০১৭ সালের বন্যায় হাসিনা বেগম নামে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা তার ছাত্রদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়েছেন, নিজেই পানিতে ডুবে যাওয়ার ধুঁকি নিয়ে।
জাহানারা খাতুন
করোনা মহামারীর সময় নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে কোভিড আক্রান্ত এলাকা থেকে রোগী ও শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন জাহানারা খাতুন।
আমাদের শিক্ষা:
সাহসী শিক্ষকরা আমাদের ভবিষ্যত গড়েন
মেহেরিন চৌধুরীর মতো নারীরা শুধু জীবন বাঁচান না, ভবিষ্যতের মানুষ গড়ে তোলেন।তাদের সাহস ও ত্যাগ থেকে আমাদের শেখা উচিত—নিজেদের ভূমিকা কেবল চাকরি নয়, বরং সমাজ ও মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার কথা মাথায় রাখা উচিত।
করণীয়: কিভাবে আমরা দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিতে পারি?
✅ শিক্ষককে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা
✅ পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা প্রদান
✅ সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা ও গুরুত্ব বাড়ানো
✅ শিশু ও তরুণদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা
উপসংহার
মেহেরিন চৌধুরী হয়তো আর কখনো স্কুলে যাবেন না, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পড়াবেন না, ছাত্র-ছাত্রীদের বিপদে- আপদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না কিন্তু প্রতিটি বিপদ থেকে বেঁচে যাওয়া প্রতিটি শিশুর হৃদয়ে জাগর থাকবেন—এক জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে। আমরা সবাই যদি তার মত সাহসী হতে শিখি, তাহলে সমাজ হবে শান্তিময় ও সুন্দর।
Comments
Post a Comment