তৃতীয় পর্ব : মাইলস্টোন ট্রাজেডি: একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিবরণ


পাঠকের প্রশ্ন:

কেন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় দুর্ঘটনার শিকার কেউ মিনিটের মধ্যে ট্রমা কেয়ার পায়, অথচ আমাদের দেশে সোনারগাঁও থেকে ঢাকায় আসতেই ঘণ্টা লাগে? বাংলাদেশ কি কখনো সেই মানের জরুরি চিকিৎসা সেবা তৈরি করতে পারবে?

"একটি দুর্ঘটনা। সময় গড়িয়ে যায় মিনিটে মিনিটে। হাসপাতাল ১০০ কিলোমিটার দূরে—আর জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে কেবল একটাই প্রশ্ন: যদি এখনই পৌঁছানো যেত?"

যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই মুহূর্তেই আকাশপথে উড়ে আসে হেলিকপ্টার—মেডিকেল টিমসহ। আর আমাদের দেশে?


স্রেফ এক মিনিট দেরি—আর তাতেই বদলে যেতে পারে কারও পুরো জীবন।

উন্নত বিশ্বে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়, হেলিকপ্টার-ভিত্তিক মেডিকেল সার্ভিস বহু প্রাণ রক্ষা করছে প্রতিদিন। দুর্ঘটনা, স্ট্রোক, হৃদরোগ—সব জরুরি অবস্থায় এই এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে যায় ঠিক সময়মতো।

বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা কতটা জরুরি? আর কেন আমাদের উন্নত স্বাস্থ্যসেবার এই দিকটি নিয়ে ভাবা দরকার এখনই?

এই নিবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে বাস্তবতা, প্রয়োজন এবং আমাদের সামর্থ্য—একটি মানবিক, জরুরি দৃষ্টিকোণ থেকে।"

যুক্তরাষ্ট্রের (USA)জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা (EMS)

যুক্তরাষ্ট্রে দুর্ঘটনা বা চিকিৎসাজনিত জরুরি অবস্থা সামলানোর জন্য অত্যন্ত সমন্বিত একটি ব্যবস্থা আছে।

911 কল সিস্টেম: মাত্র একটি কলের মাধ্যমে পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড, অ্যাম্বুলেন্স ও এয়ার মেডিকেল সেবা একসাথে সক্রিয় হয়।

Level-1 Trauma Centers: দেশজুড়ে শত শত ট্রমা সেন্টার রয়েছে যেখানে ২৪/৭ সার্জন, নিউরোসার্জন, বার্ন কেয়ার বিশেষজ্ঞ, অ্যানেস্থেটিস্ট এবং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট প্রস্তুত থাকে।

হেলিকপ্টার ও এয়ার অ্যাম্বুলেন্স: দুর্ঘটনাস্থল থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে রোগীকে এয়ার মেডিকেল টিম প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়।

প্রযুক্তি ব্যবহার: ড্রোনের মাধ্যমে রক্ত ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, এবং অ্যাম্বুলেন্সে পোর্টেবল ICU সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়।

উদাহরণ:

২০১৩ সালের বোস্টন ম্যারাথন বোমা হামলার পর মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে আহত সবাইকে ট্রমা সেন্টারে নেওয়া হয়েছিল। উন্নত সমন্বয় ও প্রশিক্ষিত টিমের কারণে অধিকাংশের জীবন রক্ষা পেয়েছিল।

কানাডার এয়ার মেডিকেল সিস্টেম

কানাডা বিস্তৃত ও দুর্গম একটি দেশ, তাই এয়ার মেডিকেল সার্ভিস তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ORNGE (Ontario Air Ambulance): প্রতিদিন গড়ে শত শত জরুরি রোগীকে বিমান বা হেলিকপ্টারের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হয়।

নর্থ কানাডা সিস্টেম: তুষারপ্রবণ বা দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টার ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি ক্রু: হেলিকপ্টারে একজন পাইলট, একজন ক্রিটিক্যাল কেয়ার নার্স এবং একজন প্যারামেডিক থাকে যারা ICU-লেভেল সেবা দিতে সক্ষম।

উদাহরণ:

২০২৩ সালে একটি তুষারঝড়ে আটকে থাকা ৩০ জন রোগীকে মাত্র ৬ ঘণ্টায় নিরাপদে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিল ORNGE হেলিকপ্টার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি

পোর্টেবল ICU: এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে রয়েছে ভেন্টিলেটর, ডিফিব্রিলেটর, মনিটরিং সিস্টেম এবং লাইফ সাপোর্ট ডিভাইস।

AI-ভিত্তিক সাড়া ব্যবস্থা: যুক্তরাষ্ট্রে অনেক অ্যাম্বুলেন্স এখন AI ব্যবহারে দ্রুত লোকেশন ট্র্যাক ও চিকিৎসার অগ্রাধিকার ঠিক করে।

ড্রোন ডেলিভারি: জরুরি ওষুধ, রক্ত, অ্যান্টি-ভেনম সরাসরি দুর্ঘটনাস্থলে ড্রোনে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা

আমাদের দেশে হেলিকপ্টার অ্যাম্বুলেন্স প্রায় অদৃশ্য। কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল অল্প পরিসরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেয়, কিন্তু তা ব্যয়বহুল এবং দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে কার্যকর নয়।

ঢাকাকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যসেবা হওয়ায় দুর্ঘটনার শিকার রোগীকে গ্রাম বা শহরতলি থেকে আনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে।

ট্রমা ও বার্ন কেয়ার ইউনিটের ঘাটতি, দক্ষ ডাক্তার সংকট এবং সমন্বয়ের অভাব জীবনহানির ঝুঁকি বাড়ায়।

আমাদের করণীয়

1. আঞ্চলিক ট্রমা ও বার্ন সেন্টার স্থাপন:

ঢাকা ছাড়াও প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিশ্বমানের ট্রমা সেন্টার গড়ে তুলতে হবে।

2. হেলিকপ্টার মেডিকেল নেটওয়ার্ক চালু:

বিমান বাহিনী ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় অন্তত ৫টি আঞ্চলিক হেলিপ্যাড তৈরি করা।

এয়ার অ্যাম্বুলেন্স টিমে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ডাক্তার, নার্স এবং প্যারামেডিক নিয়োগ।

3. বিশেষায়িত চিকিৎসক তৈরি:

প্লাস্টিক সার্জারি, ট্রমা কেয়ার এবং বার্ন ম্যানেজমেন্টে নতুন প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা।

4. জরুরি ফান্ড:

দুর্ঘটনার পর রোগীদের চিকিৎসার খরচ সরকারিভাবে কাভার করতে তহবিল তৈরি করা।

5. স্মার্ট প্রযুক্তি সংযুক্তকরণ:

অ্যাম্বুলেন্স এবং হাসপাতালের মধ্যে AI-ভিত্তিক ডাটা নেটওয়ার্ক তৈরি।

6. সচেতনতা ও মহড়া:

স্কুল, কারখানা এবং জনসমাগমস্থলে নিয়মিত অগ্নি ও দুর্যোগ মহড়া বাধ্যতামূলক করা।

উপসংহার

মাইলস্টোন দুর্ঘটনার পর সিঙ্গাপুর থেকে ডাক্তার আনার যে তৎপরতা আমরা দেখেছি, সেটি সাময়িক সমাধান।

আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত—জাপান, ইউরোপ বা কানাডার মতো দক্ষ ও দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি করা।

হেলিকপ্টার মেডিকেল সার্ভিস চালু এবং আঞ্চলিক ট্রমা সেন্টার তৈরি না করলে বড় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমানো সম্ভব নয়।

Comments

Popular posts from this blog

দ্বিতীয় পর্ব :প্রাথমিক পর্যায়ে চালু হওয়া দেশগুলোতে পি আর পদ্ধতির ধরন

প্রথম পর্ব: পি আর পদ্ধতির ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ধারায় এর প্রতিফলন

তৃতীয় পর্ব : পি আর পদ্ধতির সফলতার গল্প