প্রথম পর্ব : মাইলস্টোন ট্রাজেডি: একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিবরণ
ভয়াবহ প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা: বাংলাদেশের অবহেলা ও বাস্তবতা
এক ভয়াবহ দুপুরের গল্প
২০২৫ সালের ২১ জুলাই, ঢাকার উত্তরা মিলস্টোন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা যেমন অন্য দিনের মতো ক্লাসে মনোযোগ দিচ্ছিল, তেমনি বাইরে ছিল এক ভয়াল দৃশ্য। আকাশে টেকঅফের কিছুক্ষণের মধ্যেই এক বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে বিধ্বস্ত হয়। কয়েক মুহূর্তেই ক্লাসরুম ভরে যায় আগুনের লেলিহান শিখা, ধোঁয়ার কালো মেঘ, এবং আতঙ্কের চিৎকারে। এই দুর্ঘটনায় অন্তত ২০ জনের প্রাণহানি ঘটে, আহত হয় ৮০ জনেরও বেশি।
এমন ঘটনা কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়—এটি দেশের বিমান নিরাপত্তা এবং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ ঘাটতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতার নির্মম প্রতিচ্ছবি।
পুরনো বিমান ও প্রযুক্তিগত ত্রুটি: অজুহাত না বাস্তবতা?
দুর্ঘটনায় জড়িত বিমানটি ছিল চীনা তৈরি F-7 BGI, যা ২০১১ সালে বাংলাদেশের ফ্লিটে যুক্ত হয়। এটি তুলনামূলক নতুন হলেও, সাধারণ জনগণের মধ্যে ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে যে বিমানটি ১৯৭৬ সালের পুরনো মডেলের উন্নত সংস্করণ। প্রকৃতপক্ষে, F-7 এর প্রথম মডেল ষাটের দশকের শেষদিকে তৈরি হলেও, বর্তমান মডেলটি বহু প্রযুক্তিগত আপগ্রেডের মধ্য দিয়ে এসেছে।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়: রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়মিত ওভারহল কি যথাযথভাবে করা হয়? অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, বরাদ্দকৃত তহবিলের সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় অনেক সময় বিমানগুলি সর্বোচ্চ নিরাপত্তার পর্যায়ে থাকে না। মিলস্টোন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও পাইলট টেকঅফের পর থেকেই ইঞ্জিন ত্রুটির কথা জানিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: নিরাপত্তার বিপরীতে ঝুঁকি
ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার আকাশে প্রশিক্ষণ বিমান চালানো কতটা যৌক্তিক—এই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে। বেশিরভাগ উন্নত দেশে প্রশিক্ষণ ঘাঁটি শহরের বাইরে নির্জন এলাকায় রাখা হয়। কিন্তু ঢাকায় এয়ারবেসের অবস্থান, চারপাশে বাড়ি-স্কুল-অফিস—সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
একজন অভিভাবক, যিনি দুর্ঘটনার দিন স্কুলের গেটে দাঁড়িয়েছিলেন, বলেন:
“আমার ছেলে কয়েক মিনিট আগে ওই ক্লাস থেকে বের হয়েছিল। চোখের সামনে বিস্ফোরণ আর আগুন দেখে মনে হচ্ছিল পুরো শহর পুড়ে যাবে। এটা কি আমাদের প্রাপ্য নিরাপত্তা?”
বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার ইতিহাস
এমন দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়। গত দুই দশকে বাংলাদেশে একাধিক মারাত্মক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
1. ৯ মে ২০২৪: চট্টগ্রামে Yak-130 ট্রেনার বিমান বিধ্বস্ত হয়ে পাইলট নিহত।
2. ২৩ নভেম্বর ২০১৮: টাঙ্গাইলের মধুপুরে F-7BG বিমান ক্র্যাশ হয়ে স্কোয়াড্রন লিডার নিহত।
3. ১ জুলাই ২০১৮: যশোরে K-8W প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত, দুই স্কোয়াড্রন লিডার নিহত।
4. ২০ ডিসেম্বর ২০১০: বরিশালের কাছাকাছি দু’টি PT-6 প্রশিক্ষণ বিমান মুখোমুখি সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয়ে দুই পাইলট নিহত।
5. ৮ এপ্রিল ২০০৮: ঘাটাইলে F-7 প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে এক স্কোয়াড্রন লিডার মারা যান।
প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কিছুদিন আলোচনা হলেও কোনো বড় পরিবর্তন দেখা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান: একটি জীবন্ত দুঃস্বপ্ন
মিলস্টোন স্কুলের এক শিক্ষার্থী বলছিল,
“আমরা জানতাম না কী হচ্ছে। প্রথমে শব্দ শুনলাম, তারপর আগুন দেখতে পেলাম। আমাদের পাশের ক্লাসের কয়েকজন গুরুতর আহত হলো। আমি আজও মনে করতে পারি, কীভাবে স্যার আমাদের হাত ধরে বের করলেন।”
একজন শিক্ষক জানান, পাইলটের শেষ চেষ্টা ছিল বিমানটিকে জনবসতিহীন দিকে ঘোরানো।
“পাইলট যদি শেষ মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত না নিতেন, হয়তো আরও শতাধিক প্রাণহানি ঘটতো।”
এই সাক্ষ্যগুলো শুধু দুর্ঘটনার ভয়াবহতা নয়, আমাদের সিস্টেমের ব্যর্থতার কথাও মনে করিয়ে দেয়।
কেন সরকারের টনক নড়ে না?
বিমান দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন হলেও তার রিপোর্ট সচরাচর জনসমক্ষে আসে না। প্রতিটি ঘটনায় দেখা যায় প্রাথমিক তদন্তে “প্রযুক্তিগত ত্রুটি” বা “মানবিক ভুল” বলা হলেও এর গভীরে যাওয়া হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
“প্রশিক্ষণ বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ, যন্ত্রাংশ পরিবর্তন, এবং নিরাপত্তা চেক—এসবের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ থাকে, তা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার না হয়, তাহলে দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে যায়।”
দেশে বিমান নিরাপত্তার সংস্কৃতি কেমন?
বাংলাদেশের বিমান নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতিমালা অনেক সময় কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রশিক্ষণ বিমানগুলোর ফ্লাইট লগ, সার্ভিস হিস্ট্রি, এবং মেকানিক্যাল রিপোর্টগুলো স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা হয় না। ফলে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জনগণের কোনো ধারণা থাকে না।
একজন অবসরপ্রাপ্ত পাইলট বলেন,
“আমরা যখন প্রশিক্ষণ নিতাম, তখনো পুরনো বিমান ব্যবহারের ঝুঁকি ছিল। এখন প্রযুক্তি এগিয়েছে, কিন্তু আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা তেমন বদলায়নি।”
জনগণের প্রতিক্রিয়া: ক্ষোভ ও হতাশা
দুর্ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। অনেকে বলছে,
“জনবহুল এলাকায় কেন প্রশিক্ষণ ফ্লাইট? কেন পুরনো বিমান দিয়ে ঝুঁকি বাড়ানো হচ্ছে?”
একজন অভিভাবক লিখেছেন,
“আমরা আমাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাই শেখার জন্য, মরতে নয়।”
কী শেখা দরকার?
প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনা থেকে উন্নত দেশগুলো যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি শিখেছে, তা হলো স্বচ্ছতা এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রে যদি একটি প্রশিক্ষণ জেট দুর্ঘটনায় পড়ে, কয়েক দিনের মধ্যেই তদন্তের অগ্রগতি জানানো হয় এবং সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পুরো ফ্লিট গ্রাউন্ডেড রাখা হয়।
বাংলাদেশে তা না করে, অনেক সময় একই মডেলের বিমান কিছুদিন পর আবার উড়তে শুরু করে—যেন কিছুই হয়নি।
উপসংহার
মিলস্টোন স্কুল দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—এখনো সময় আছে, কিন্তু এই সময়টা যদি কাজে না লাগানো হয়, তবে আগামী দুর্ঘটনা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
Comments
Post a Comment