১৯৯০ গণঅভুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তর এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা
![]() |
বেগম খালেদা জিয়া |
🔹 সূচনা: আবর্তিত নেতৃত্ব ও স্থিতিশীলতার অভাব
১৯৯০ সালের ডিসেম্বর। দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করে—অবশেষে স্থায়ী, প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের স্বপ্ন ভেঙে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব দেশের জন্য নতুন সুযোগ নিয়ে আসেনি—বরং বারবার অবর্ত ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত করেছে। তিন দলের নির্বাচনের রূপরেখা সংবিধানে সংযোজন না করা, মাগুরার উপ-নির্বাচনে আশ্রয় নেওয়া, রাজনৈতিক চুক্তি এবং অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনিয়ম—এসব প্রক্রিয়া দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে।
পরিস্থিতি এমন ছিল যে, ছাত্র আন্দোলন, বিক্ষোভ এবং দীর্ঘ অসহযোগ আন্দোলন বারবার পুনরাবৃত্তি হতে হয়েছে। দেশের গণতন্ত্র স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, বরং এক আন্দোলন থেকে আরেক আন্দোলনের আবর্তে দেশকে ঠেলে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আমাদেরকে নেতৃত্বের চরিত্র এবং প্রশাসনিক দক্ষতার সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে—যেখানে কার্যকর সংস্কার ও স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি না থাকলে দেশ সংকট থেকে মুক্তি পায় না।
রাজনৈতিক চক্রান্ত, দলীয় প্রতিহিংসা এবং প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে সংকটের চক্র কখনও থামেনি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আন্দোলন থেকে অন্য আন্দোলনে স্থানান্তরিত হওয়া প্রায় নিয়মিত ঘটনা।
![]() |
বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী |
🔹 ১৯৯০–৯১ পরবর্তী সরকার: দায়িত্ববোধ ও সীমাবদ্ধতা
খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে দেশের জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন।
স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গণমাধ্যম ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় কিছু উদ্যোগ।
বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের চেষ্টা।
নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা।
কিন্তু সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট ছিল।
1. প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব: দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও সংবিধানিক সংস্কার কার্যকর করতে অসফল।
2. দলীয় মনোভাব ও স্বজনপ্রীতি: কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে স্বার্থপরতা ও দলীয় প্রভাব।
3. নির্বাচনের রূপরেখা প্রয়োগে ব্যর্থতা: তিন দলের অংশগ্রহণ সংবিধানে সংযোজন না করা।
4. বারবার হোঁচট খাওয়া: মাগুরার উপ-নির্বাচনে আশ্রয় নেওয়া, যার ফলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন হয়নি।
ফলশ্রুতিতে, ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক অসহযোগ আন্দোলন বারবার প্রয়োজন হয়ে ওঠে। দেশের গণতন্ত্র স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।
🔹 গণতন্ত্রের হোঁচটের কারণ
বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার কারণগুলো কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:
1. দলীয় আধিপত্য ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা:
নির্বাচনের পর বিরোধীদের কার্যকর অংশগ্রহণ সীমিত।
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ক্ষুণ্ণ।
2. সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতা:
স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও শক্তিশালী সংবিধানিক নিয়ন্ত্রণের অভাব।
প্রশাসনিক সংস্কার প্রায়ই রাজনৈতিক প্রভাবের অধীনে।
3. গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের সীমাবদ্ধতা:
রাজনৈতিক চাপের কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ।
বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা হ্রাস।
ফলশ্রুতিতে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ স্থাপন ব্যর্থ হয়। ছাত্র আন্দোলন, বিক্ষোভ ও অসহযোগ আন্দোলন বারবার পুনরাবৃত্তি হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় বি. জে. হাবিবি সঠিক প্রশাসনিক দক্ষতা ও সততা দিয়ে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব বিপরীত পথে গেছে।
যদি বাংলাদেশে সেই সময়ে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে নির্বাচিত করা হতো, পরিস্থিতি ভিন্ন হতো—গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ অর্জন সম্ভব হতো।
কিন্তু খালেদা জিয়া নির্বাচিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা ও পরিবারের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে মনোনিবেশ করেছেন, এবং প্রশাসনিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনেকাংশে অনুপস্থিত ছিল।
ক্ষমতার মোহ, স্বজনপ্রীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা:
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা উপেক্ষা করা।পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা। তিন দলের নির্বাচনের সংবিধানিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করা, এবং নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য রূপরেখাকে উপেক্ষা—এসব সিদ্ধান্ত দেশের গণতন্ত্রকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পরিবর্তে স্থিরতার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে।
নারী নেতা হওয়া সত্ত্বেও, খালেদা জিয়া ক্ষমতার প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ প্রদর্শন করেছেন,। তার এই ক্ষমতার মোহ গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে, যা অনেকটা গলা টিপে ধরার মতো। ফলে পরবর্তী সময়ে, শেখ হাসিনার মতো নেতারা সেই সীমাবদ্ধতা বা ব্যবধানকে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করেছেন।
“রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রশাসনিক দক্ষতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব ছিল স্পষ্ট। ফলে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপে স্থাপন না হয়ে, রাজনৈতিক সংকটের চক্র চলতে থাকে। নির্বাচনের পর সরকারি সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা চলমান থাকে।
ইন্দোনেশিয়ায় বি. জে. হাবিবি সঠিক প্রশাসনিক দক্ষতা ও সততা দিয়ে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব বিপরীত পথে গেছে।
যদি বাংলাদেশে সেই সময়ে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে নির্বাচিত করা হতো, পরিস্থিতি ভিন্ন হতো—গণতন্ত্রের স্থায়িত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ অর্জন সম্ভব হতো।
কিন্তু খালেদা জিয়া নির্বাচিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা ও পরিবারের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে মনোনিবেশ করেছেন, এবং প্রশাসনিক দক্ষতা, প্রজ্ঞা বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনেকাংশে অনুপস্থিত ছিল।
করণীয় বনাম বাস্তবতা
১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর খালেদা জিয়ার জন্য দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল একেবারে সংবেদনশীল। উনার করণীয় ছিল:
1. সংবিধান ও নির্বাচনী রূপরেখা প্রণয়ন করা
তিন দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের স্বাধীনতা বজায় রাখা।
2. প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়ন করা
স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
3. রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতা
বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা গড়ে তোলা।
4. গণমাধ্যম ও বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষা
প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক চাপ কমিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বৃদ্ধি করা।
কিন্তু বাস্তবতা:
উনি এই রূপরেখার প্রতি পুরোপুরি মনোনিবেশ করেননি।
ক্ষমতা ও পরিবারের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে গিয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে অনেকাংশে অবহেলা করেছেন।
বিরোধীদলীয় সংলাপ প্রায় সীমিত ছিল, ফলে রাজনৈতিক সংঘাত বারবার ঘূর্ণপাক খেয়েছে।
নির্বাচনের নিয়মাবলী আংশিকভাবে প্রয়োগ হয়েছে, এবং স্থানীয় প্রশাসনের স্বচ্ছতা কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
বিচার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর রাজনৈতিক প্রভাব অব্যাহত ছিল।
ফলাফল:
গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
রাজনৈতিক সংকট ও আন্দোলন বারবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
ছাত্র আন্দোলন, হরতাল ও বিক্ষোভের চক্র দীর্ঘায়িত হয়েছে।
🔹 আন্তর্জাতিক তুলনা: ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক
ইন্দোনেশিয়া
১৯৯৮ সালে সুহার্তোর দীর্ঘ একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পর বি. জে. হাবিবি প্রেসিডেন্ট হন।
স্বচ্ছ নির্বাচন ও রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি।
স্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
মাত্র ১৭ মাসে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়।
বি. জে. হাবিবি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কিভাবে নিশ্চিত করেছেন।
ইন্দোনেশিয়ার স্থিতিশীলতা দেখিয়ে দেয়, যে দক্ষ প্রশাসনিক নেতৃত্ব ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, এবং দেশের রাজনৈতিক হোঁচট কতোটা দীর্ঘায়িত হতে পারে।”
মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্ক
দৃঢ় নেতৃত্ব ও কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার গণতন্ত্রকে স্থায়ী করেছে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের তুলনায় দেখা যায়, শুধু উদ্দেশ্য যথেষ্ট নয়; প্রশাসনিক দক্ষতা ও সংবিধানিক সংস্কার অপরিহার্য।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, শাহাবুদ্দিন আহমেদকে দায়িত্বে নেওয়া হলে দেশ হয়তো স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের দিকে এগোত।” যেমনটা এগিয়েছে বিজে হাবিবির নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়া।
“কিন্তু খালেদা জিয়ার নির্বাচনের ফলে সেই সুযোগ নষ্ট হয়, এবং দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিপরীত পথে চলে
🔹 ছাত্র আন্দোলনের ভিন্ন বাস্তবতা
ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালে ছাত্ররা প্রথমবার মাঠে নামেন। এরপর আর কোনো সরকার পতনের জন্য তাদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হয়নি।
বাংলাদেশের তুলনায় পরিস্থিতি ভিন্ন:
১৯৯০ সালের এরশাদ সরকারের পতনের পরও ছাত্র আন্দোলন, বিক্ষোভ ও রক্তপাত পুনরায় ঘটেছে।
ছাত্রদের বারবার ব্যবহার হয়েছে রাজনৈতিক চক্রান্তের জন্য।
স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না থাকায় দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হয়েছে।
🔹 শিক্ষণীয় পাঠ
খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব থেকে পাওয়া শিক্ষণীয় বিষয়গুলো:
1: প্রশাসনিক দক্ষতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অপরিহার্য।
2. স্বচ্ছতা ও সংবিধানিক সংস্কার জরুরি: নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
3. জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ: গণতন্ত্র শুধু ভোট নয়, স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সচেতন নাগরিকের অংশগ্রহণের ওপর নির্ভর করে।
🔹 উপসংহার:
গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, কার্যকর প্রশাসন ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বয়। যেখানে এই সমন্বয় নেই, সেখানে ক্ষমতার মোহ বা স্বার্থপরতা দেশের গণতন্ত্রকে হোঁচট খেতে বাধ্য করে।
বাংলাদেশের এই ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি—নেতৃত্বের চরিত্র, প্রজ্ঞা ও প্রশাসনিক দক্ষতা না থাকলে গণতন্ত্র স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
Comments
Post a Comment