বি জে হাবিবি এবং ইন্দোনেশিয়ায় গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম
![]() |
বি জে হাবিবি |
"কখনও কখনও ইতিহাস এমন এক দরজা খোলে, যেখান দিয়ে জাতি প্রবেশ করে অন্ধকার থেকে আলোয়। ১৯৯৮ সালের ইন্দোনেশিয়া ছিল সেই মুহূর্তের সাক্ষী। সুহার্তোর দীর্ঘ তিন দশকের শাসন ভেঙে পড়ল, আর নেতৃত্বের ভার এসে পড়ল এমন একজন মানুষের হাতে, যিনি ছিলেন প্রকৌশলী, স্বপ্নদ্রষ্টা এবং অপ্রস্তুত—কিন্তু ইতিহাস তাঁকে বেছে নিয়েছিল। তিনি ছিলেন বি. জে. হাবিবি, যিনি স্বল্প সময়ে হলেও ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের স্থপতি হয়ে ওঠেন।
১. স্বৈরশাসনের দীর্ঘ ছায়া: সুহার্তো ও “নতুন শাসন ব্যবস্থা”
১৯৬৭ সাল থেকে ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতির ওপর দাপট দেখিয়েছিলেন সুহার্তো। তাঁর শাসন ছিল “নিউ অর্ডার”—একটি সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, যেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল সীমিত, গণমাধ্যম ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে, আর রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত “Golkar”-এর ছায়াতলে আবদ্ধ।
তবে সুহার্তো শুধু রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণেই থেমে থাকেননি। তিনি অর্থনীতিকে আমলাতান্ত্রিক ও সামরিক পৃষ্ঠপোষকতার কাঠামোয় বেঁধে ফেলেছিলেন। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সম্পদের বৈষম্য সমাজে গভীর ক্ষোভ তৈরি করেছিল।
১৯৯৭ সালের এশিয়ান অর্থনৈতিক সংকট সেই ক্ষোভকে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।
মুদ্রার পতন
বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের বিস্তার
ছাত্র আন্দোলন ও জনবিক্ষোভ
অবশেষে ১৯৯৮ সালের মে মাসে সুহার্তো ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন। ইন্দোনেশিয়া তখন এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে—অরাজকতা, সহিংসতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। আর ঠিক তখনই প্রেসিডেন্ট হলেন তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও প্রযুক্তিবিদ, বাচারুদ্দিন জুসুফ হাবিবি।
২. হাবিবির আবির্ভাব: অপ্রস্তুত নেতা, অমর পরিবর্তন
![]() |
নতুন দায়িত্বে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে বি জে হাবিবির শপথ গ্রহণ
হাবিবি কখনোই ভাবেননি তিনি প্রেসিডেন্ট হবেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শিক্ষিত ও দূরদর্শী নেতা। জার্মানিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন এবং বিশ্বমানের বিমান প্রকৌশল অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন মানুষ।সরকারের শিল্প ও প্রযুক্তি মন্ত্রী হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন।সুহার্তো সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসনিক এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে জড়িত ছিলেন । তাই অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি সুহার্তোর ক্রীড়নক হয়ে থাকবেন।
কিন্তু ইতিহাসের মোড় অন্য কথা বলে অন্য কথা।
তিনি সুহার্তোর দীর্ঘ শাসনের ছায়া বা পুরনো প্রশাসনিক কুপ্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন।
ক্ষমতায় আসার পরও কোনো স্বজনপ্রীতি বা ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেননি। তাঁর প্রত্যেক পদক্ষেপই দেশের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণ ও ন্যায়পরায়ণতার ওপর ভিত্তি করেছিল। এই নৈতিক দৃঢ়তা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণই তাকে একটি স্বতন্ত্র নেতৃত্বে পরিণত করেছিল, যা স্বল্প সময়ে হলেও ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।বিশ্বমানের বিমান প্রকৌশল অভিজ্ঞতা তাঁকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তিবাদী ও কার্যকরী করে তুলেছিল।শুধু প্রযুক্তি ও প্রশাসনিক দক্ষতাই নয়, তিনি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোকে সমাধান করার সময়ও দৃঢ় মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন।
সাহসিকতা, নৈতিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হাবিবির নেতৃত্বের মূল বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিগত স্বার্থকে পশ্চাৎ পটে রেখে জনগণের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এই নেতৃত্বই তাকে ইতিহাসে স্থায়ী সন্মান এনে দিয়েছে।
মাত্র ১৭ মাস ক্ষমতায় থেকেও তিনি এমন সব পদক্ষেপ নিলেন, যা ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্রের ভিতকে দৃঢ় করে দেয়।
৩. গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হাবিবির পদক্ষেপ
ক) রাজনৈতিক স্বাধীনতা
হাবিবি ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা দিলেন, রাজনৈতিক দল গঠন ও নিবন্ধনের ওপর আর কোনও কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। অল্প কয়েক মাসের মধ্যে শতাধিক দল আত্মপ্রকাশ করে। দীর্ঘদিনের একদলীয় আধিপত্য ভেঙে গেল।
খ) সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
সুহার্তোর আমলে সাংবাদিকরা ছিলেন সেন্সরশিপের বন্দি। হাবিবি সেই শৃঙ্খল ভেঙে দিলেন। সংবাদপত্র লাইসেন্সিংয়ের কঠোর নিয়ম শিথিল করলেন, ফলে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে সরকার সমালোচনা করতে পারল।
গ) নির্বাচন কমিশন ও নতুন আইন
ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য হাবিবি নতুন নির্বাচন আইন চালু করেন। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করা হয়, ভোটার তালিকা সংস্কার করা হয়, এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। ১৯৯৯ সালের নির্বাচন হয় ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক।
ঘ) মানবাধিকার ও রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি
হাবিবি কয়েকশ রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেন। এতে জনগণের আস্থা বাড়ে এবং সরকারের প্রতি নতুন এক বিশ্বাস জন্মায়।
ঙ) আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন
ইন্দোনেশিয়া হচ্ছে হাজারো দ্বীপের দেশ। কেন্দ্রীয়কৃত শাসন ব্যবস্থা স্থানীয় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল। হাবিবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আইনের উদ্যোগ নেন, যা পরবর্তী সরকারগুলো আরও শক্তিশালী করে।
চ) টিমর-লেস্তে গণভোট
হাবিবির সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ ছিল টিমর-লেস্তের জনগণকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি গণভোটের আয়োজন করেন। যদিও ফলাফলের পর সহিংসতা দেখা দেয়, তারপরও এই পদক্ষেপ ইন্দোনেশিয়াকে বিশ্বমঞ্চে নতুন সম্মান এনে দেয়।
৪. সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা
অবশ্যই হাবিবির সময়টা সহজ ছিল না।
অর্থনীতি তখনও দুর্বল অবস্থায়।
সামরিক বাহিনী নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছিল।
টিমর-লেস্তে সংকট তাঁর জনপ্রিয়তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
কিন্তু এইসব সত্ত্বেও হাবিবির নেওয়া পদক্ষেপগুলো ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসে এক স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।
৫. বাংলাদেশ: সুযোগ পেয়েও হারানো সম্ভাবনা
১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশের জনগণও নতুন গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু তিন দশক পার হয়ে গেলেও আজও সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি।
নির্বাচন ব্যবস্থা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে।
নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
পরিবারতন্ত্র রাজনীতিকে দখল করে রেখেছে।
গণমাধ্যম অনেক সময় স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পায় না।
অতএব যেখানে ইন্দোনেশিয়া অল্প সময়েই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিল, বাংলাদেশ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি।
৬. অন্য দেশের ব্যর্থ অভিজ্ঞতা
ক) মিসর
২০১১ সালে আরব বসন্তে হোসনি মুবারক পতন ঘটে। জনগণের মধ্যে তীব্র গণতন্ত্রের প্রত্যাশা জেগে ওঠে। দেশের ইতিহাসের প্রথম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার গঠিত হয়। কিন্তু সেই সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর চরম দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে শিগগিরই সামরিক বাহিনী ফের ক্ষমতায় আসে। গণতন্ত্রের কবর রচিত হয় ।
খ) পাকিস্তান
পাকিস্তানে বহুবার সামরিক শাসনের পতন ঘটেছে, গণতন্ত্র এসেছে , কিন্তু আবারও সেনারা ক্ষমতা দখল করেছে। আজও দেশটি একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে পারেনি।
গ) মিয়ানমার
দীর্ঘ সামরিক শাসনের পরে অহিংস আন্দোলনের নেত্রী, গণতন্ত্রের পূজারী অং সান সু চি-র নেতৃত্বে একসময় গণতন্ত্ এসেছিল । কিন্তু ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থান আবার সবকিছু বদলে যায় ।
ঘ) জিম্বাবুয়ে
আফ্রিকার দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একনায়ক মুগাবের পতনের পরও সেখানে গণতন্ত্র আসেনি। ক্ষমতার পালাবদল হলেও শাসনব্যবস্থা রয়ে গেছে স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্রে।
ঙ) সুদান
আফ্রিকার দেশ সুদানে চলেছিল যুগের পর যুগ একনায়ক ওমর আল-বশিরের শাসন। কিন্তু তার পতনের পর জনগণ ভেবেছিল গণতন্ত্র আসবে। কিন্তু সামরিক কাউন্সিল ক্ষমতা ধরে রাখে, গণতন্ত্র ফিরে নি ।
৭. ইন্দোনেশিয়ার সাফল্যের রহস্য
কেন ইন্দোনেশিয়া পারল, আর অন্যরা পারল না?
সেখানে হাবিবির মতো নেতৃত্ব ছিল যিনি স্বৈরশাসকের ছায়া থেকে উঠে আসলেও জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন,রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করে ক্ষমতায়িত করেছিলেন । যেমন নির্বাচন কমিশন, সংবাদপত্র, রাজনৈতিক দল কে পুনর্গঠন করে গড়ে তুলেছিলেন।তিনি জনগণের ইচ্ছাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
এ কারণেই আজ ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে নিয়মিত নির্বাচন হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে।
৮. উপসংহার
গণঅভ্যুত্থান শুধু স্বৈরশাসকের পতন ঘটায়। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও দূরদর্শী নেতৃত্ব।
বাংলাদেশ, মিসর বা সুদানের মতো দেশগুলো সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি।
কিন্তু ইন্দোনেশিয়া পেরেছে।কারণ সেখানে একজন হাবিবি ছিলেন, যিনি স্বল্প সময়ের মধ্যে জনগণের জন্য গণতন্ত্রের দরজা খুলে দিলেন।
"ইতিহাস আমাদের শেখায়—গণতন্ত্র সুযোগ নয়, এটি তৈরি করতে হয়। আর সাহসী নেতৃত্বই পারে সেই ইতিহাসকে রাঙিয়ে তুলতে।"


Comments
Post a Comment