স্বৈরশাসনের ছায়া থেকে গণতন্ত্রের পথে: বাংলাদেশ ও বিশ্ব
📘 পর্ব ১:
স্বৈরশাসকের পতনের পরে রাষ্ট্র পুনর্গঠন: বাংলাদেশ কেন বার বার হোঁচট খায়?
“একজন শাসকের পতনই কি যথেষ্ট? নাকি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র বিনির্মিত হয় জনগণের সম্মিলিত সংগ্রামে?”
🟦 পাঠকের প্রশ্ন:
একজন স্বৈরাচারের বিদায় হলে কি একটি জাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুক্ত হয়ে যায়? নাকি সত্যিকারের মুক্তির জন্য প্রয়োজন হয় আরও গভীর সংস্কার ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস?
১. ভূমিকা: শাসক নয়, শাসনের ধরনই আসল চ্যালেঞ্জ
স্বৈরাচার পতনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি হল—মানুষ ধরে নেয়, শাসক চলে গেলে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শাসক নয়, ব্যবস্থাটাই যদি অক্ষত থাকে, তাহলে শুধু মুখ বদলায়, দুঃশাসনের চেহারা বদলায় না। বাংলাদেশ বারবার সেই একই আবর্তে আটকে পড়ে—শাসক বদলায়, কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাজনীতির চরিত্র বদলায় না।
২. স্বৈরতন্ত্র: সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
স্বৈরতন্ত্র কোনো সাধারণ রাজনৈতিক মত নয়—এটি ব্যক্তিপূজার, ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের শাসনপ্রণালী। স্বৈরশাসক নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে:
বিচারব্যবস্থাকে করায়ত্ত করে
প্রশাসন ও সেনাবাহিনীকে ব্যক্তিগত অস্ত্র বানায়
গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করে
নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে
৩. একদলীয় বাকশাল কায়েম এবং বঙ্গবন্ধুর শোকাবহ মৃত্যু ও ক্ষমতার ধস
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি সংবিধান সংশোধন করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে মাত্র একটি রাজনৈতিক দল বাকশাল কায়েম করেন। সরকারি চারটি সংবাদপত্র ব্যতীত সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করেন।পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ট্রাজেডির পর বাংলাদেশ এক অন্ধকার অধ্যায়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনা-সমর্থিত শাসন, এবং এরপর একের পর এক সামরিক উত্থান রাজনীতিকে অবনতির পথে ঠেলে দেয়।
৪. জিয়াউর রহমানের উদয়: গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরশাসন
মেজর জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল ছিল একটি ক্লাসিক্যাল কেস। তিনি নিজেকে জনগণের রক্ষক বলে দাবি করলেও,
সংবিধান সংশোধন করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেন
দলীয় রাজনীতিকে সামরিক শৃঙ্খলার আওতায় আনেন
বহুদলীয় গণতন্ত্র নামে প্রকৃতপক্ষে একদলীয় আধিপত্য তৈরি করেন
৫. এরশাদ: একজন ঘৃণিত শাসক অথচ টিকে থাকা স্বৈরাচার
১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রায় নয় বছর রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। তিনি:
প্রেসিডেন্ট পদে নিজেকে বসান
ধর্মীয় রাজনীতিকে বৈধতা দেন
১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালের নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেন
১৯৯০ সালে, ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল তার পতন ঘটে।
৬. ১৯৯১-এর গণতন্ত্র: নতুন সূর্নাযোদয় না পুরনো ছায়া?
এরশাদ পতনের পর দেশে গণতন্ত্রের সূচনা হয়, কিন্তু তা ছিল রূপে গণতন্ত্র, চরিত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বৈরতন্ত্র।
এরশাদ পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া তিন দলের রুপরেখা বাস্তবায়ন না করা।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্ধ আনুগত্য
গণমাধ্যম ও বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের সুবিধায় ব্যবহার
দলীয়করণ ও প্রশাসনিক পক্ষপাত
যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার মানসিকতা
দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা
পরিবার তান্ত্রিক রাজনীতির শক্ত ভিত্তি তৈরি করা
৭. শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্র: দীর্ঘতম আধিপত্য
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর যে আশা জন্মেছিল, তা দ্রুত পরিণত হয়:
বিচারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ
মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ
সরকারি চাকরিতে ৫৬℅ কোটা নির্ধারণ করে দিয়ে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ দানের ব্যবস্থা করা
একের পর এক ভুয়া নির্বাচন, দিনের ভোট রাতে করার অদ্ভুত সংস্কৃতি প্রচলন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মানবাধিকার লঙ্ঘন
গুম খুন এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা
ভারতের চরম আনুকূল্য পেতে, দেশের জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দান করা
সর্বশেষ ২০২৪ সালে ছাত্র জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে হাসিনার পতন ।
৮. তাহলে প্রশ্ন: কেন বাংলাদেশ বারবার ব্যর্থ হয়?
🔻 ১. প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি পূজা
জনগণ দল নয়, নেতাকে ভালোবাসে বা ঘৃণা করে। ফলে গণতান্ত্রিক চর্চা হয় না।
🔻 ২. বিচারহীনতার সংস্কৃতি
শাসকদের অপরাধের বিচার না হওয়ায় ভবিষ্যৎ শাসকরাও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
🔻 ৩. দুর্বল সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়া
ভয়, নিয়ন্ত্রণ ও সুবিধা ভোগের কারণে সৎ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে না।
🔻 ৪. তরুণদের রাজনৈতিক অনীহা
বহু তরুণ রাজনীতিকে “নোংরা খেলা” হিসেবে দেখে দূরে থাকে।
৯. ইতিহাসের পাঠ: পতন যথেষ্ট নয়, কাঠামো বদলাতে হয়
দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা শুধু সরকার বদলাননি—তিনি একটি Truth and Reconciliation Commission গড়ে জাতীয় আত্মবিশ্লেষণের পথ তৈরি করেন।
ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তোর পতনের পর নতুন সংবিধান, গণতান্ত্রিক সংস্কার ও বিচারব্যবস্থার পুনর্গঠন হয়।
বাংলাদেশে এসব হয়নি—হয়নি কোনো Truth Commission, হয়নি রাজনৈতিক সহমতের ভিত্তিতে সংস্কার।
🔚 উপসংহার:
“একজন স্বৈরশাসকের পতন আমাদের রক্ত গরম করতে পারে। কিন্তু একটি জাতির মুক্তির জন্য প্রয়োজন শান্ত মাথায় গড়া সংস্কারের রূপরেখা।”
বাংলাদেশ সেই পরীক্ষায় বারবার ফেল করেছে—পতনের উল্লাসে হারিয়েছে ভবিষ্যতের ভিত। পরবর্তী পর্বে আমরা দেখব—বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পতনের পর কীভাবে তারা রাষ্ট্র গঠন করেছে, আর কী পাঠ বাংলাদেশ নিতে পারে।
Comments
Post a Comment