মাইলস্টোন ট্রাজেডি: একটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার বিবরণ


পর্ব : ২

 দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশের বিমান নিরাপত্তার চিরন্তন ব্যাধি

ভয়াবহ দুর্ঘটনার পেছনে টানটান অবস্থা

বাংলাদেশের সামরিক ও প্রশিক্ষণ বিমান খাতে দীর্ঘদিন ধরে গোপন দুর্ভোগ ও সংকট চলমান, যা সাধারণ জনগণের সামনে খুব একটা প্রকাশ পায় না। ২০২৫ সালের মিলস্টোন স্কুল বিমান দুর্ঘটনার পর ফের আলোচনায় এসেছে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, বাজেটের অপব্যবহার এবং রাজনৈতিক অমনোযোগের বিষাদময় অধ্যায়। বিমান নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত এই সমস্যাগুলো শুধু সামরিক ব্যবস্থারই নয়, জাতীয় নিরাপত্তারও বড় সংকেত।

সাবেক বিমানবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ও দুদকের তদন্ত

সর্বশেষ দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে সাবেক বিমানবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ। যদিও তদন্ত এখনো চলমান, তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই দুর্নীতির ছায়া বিমান বাহিনীর আধুনিকায়ন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে।

দুর্নীতি প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত একজন সামরিক কর্মকর্তা বলেন,

“যখন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ প্রধান হয়ে যায়, তখন দেশের নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার হয় না। এতে সরাসরি ক্ষতি হয় ফ্লাইট নিরাপত্তা ও আধুনিকায়নের গতি কমে যায়।”

এই দুর্নীতির ফলে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ ফ্লিট আপগ্রেডে পরিকল্পিত প্রকল্পগুলো বিলম্বিত হয়েছে, নতুন বিমান কেনার বাজেট বঞ্চিত হয়েছে, এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থায় বড় ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বিমান পরিচালনায়, নিরাপত্তায় এবং অবশেষে মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

বিমান আধুনিকায়নে অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব

গত দশকে সরকার কয়েকবার নতুন প্রশিক্ষণ বিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে দুর্নীতি, অনিয়ম ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এসব প্রকল্প বহুবার আটকে যায়।

সরকারি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে,

“প্রশিক্ষণ বিমানগুলোর নিরাপত্তা ও আধুনিকায়নের জন্য বরাদ্দ তহবিল থাকে, কিন্তু তা সময়মতো ব্যয় না হওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।”

রাজনৈতিক অমনোযোগ ও স্বার্থনির্ভরতার কারণে নিরাপত্তার বিষয়গুলো সাধারণত প্রাধান্য পায় না। ভোটারবিহীন সরকার ও রাজনৈতিক ভন্ডামির কারণে নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ পরিমিত ও ব্যবহারিক হয় না, যা বড় সঙ্কটের জন্ম দেয়।

অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের সমস্যা

প্রশিক্ষণ বিমানের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কার্যক্রম যথাযথ হচ্ছে না—এটি বহু পাইলট ও মেকানিকদের অভিজ্ঞতার বয়ানে উঠে এসেছে। আধুনিক যন্ত্রাংশের অভাব, লজিস্টিক জটিলতা, এবং অর্থের অনিয়মের কারণে বিমানগুলি প্রায়ই ঝুঁকির মুখে থাকে।

একজন পাইলট জানিয়েছেন,

“পুরনো মেশিনের সাথে নতুন প্রযুক্তি মেলানো কঠিন। রক্ষণাবেক্ষণ যদি সঠিক না হয়, তাহলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিন্তু বাজেটের ঘাটতি ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে উন্নতি আসছে না।”

এছাড়াও পাইলট ও প্রশিক্ষণ স্টাফদের অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ উন্নত করার তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। ফলে ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

কেন ব্যবহার হচ্ছে এখনো চীনা F‑7 যুদ্ধবিমান?

বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ১৯৮০-এর দশক থেকে চীনের তৈরি Chengdu F-7 যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে আসছে, যা মূলত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের MiG-21 এর ক্লোন সংস্করণ। বিশ্বের বহু দেশ যেখানে এই বিমানের ব্যবহার থেকে সরে গেছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো এগুলোর ওপর নির্ভর করে চলেছে।

২০০৫ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে কিছু F‑7BGI মডেলের কিছুটা আধুনিক সংস্করণ যুক্ত হলেও, এই বিমানের মূল কাঠামো, ডিজাইন, রাডার, এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অপ্রচলিত।

চীনের নিজস্ব রেকর্ড অনুসারে, তারা ২০১৩ সালেই F‑7 এর উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে সেই বিমানের ব্যবহার চলছে, এমনকি জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণের জন্য।

চীন‑বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ও বারবার মেরামতের অনুরোধ উপেক্ষা 

চীন সরকার একাধিকবার বাংলাদেশকে F‑7 ও K‑8 বিমানের সীমাবদ্ধতা ও ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা গেছে, চীন বারবার রি-ইঞ্জিনিয়ারিং, পার্টস আপগ্রেড ও সিস্টেম মডিফিকেশনের প্রস্তাব দিয়েছে।

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ সেগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়নি।

কারণগুলো হলো:

স্বচ্ছতার অভাব

রাজনৈতিক অগ্রাধিকার ও সিদ্ধান্তগত গাফিলতি

নতুন কেনাকাটায় আগ্রহ, যেখানে কমিশন ও ডিলের সুযোগ বেশি

পুরনো বিমান মেরামতের প্রতি উদাসীনতা

চীনের সতর্কবার্তা ছিল স্পষ্ট—

 "F‑7 বিমানের রাডার সিস্টেম, ফ্লাইট কন্ট্রোল ও ফুয়েল লাইন আপগ্রেড না করলে তা ভবিষ্যতে বিপজ্জনক হবে।"

এই বার্তা উপেক্ষার মূল্য যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তা আমরা মাইলস্টোনে দেখেছি।

দুর্নীতি ও অনিয়ম: কেন বারবার উপেক্ষিত হয়েছে?

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, দালালতন্ত্র ও অস্বচ্ছ চুক্তি প্রক্রিয়া চালু আছে।
বিশ্ববিখ্যাত সংস্থা Transparency International তাদের "Government Defence Integrity Index" রিপোর্টে বাংলাদেশকে বারবার ‘High Risk’ ক্যাটাগরিতে ফেলেছে।

অনিয়মগুলো হলো:

প্রকৃত প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যাচাই না করে ‘ডিলভিত্তিক’ সিদ্ধান্ত

কমিশন ও মধ্যস্বত্বভোগী প্রভাবশালী গোষ্ঠীর আধিপত্য

পুরাতন মেরামত না করে নতুন কেনাকাটার দিকে ঝোঁক

রাজনৈতিক প্রভাব এবং সামরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিকায়নের অভাব

এই প্রেক্ষাপটেই পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ F‑7 বিমানের পুনর্ব্যবহার একটি দুর্ঘটনা নয়—একটি নীতিগত ব্যর্থতা।

প্রশিক্ষণে পুরনো যুদ্ধবিমান ব্যবহারের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ

সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো—কেন এমন পুরনো, ঝুঁকিপূর্ণ যুদ্ধবিমান একটি জনবহুল এলাকার উপর দিয়ে প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা হচ্ছিল?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনকার যুগে প্রশিক্ষণের জন্য রয়েছে আধুনিক, নিরাপদ উপায়:

উচ্চ মানের ফ্লাইট সিমুলেটর

টার্বোপ্রপ ট্রেইনার, যা নিরাপদ ও খরচসাশ্রয়ী

নির্জন অঞ্চল নির্ধারণ

 এ ঘটনার প্রতিটি দিক উপেক্ষিত হতে দেখেছি   এক্ষেত্রে যা মাইলস্টোন কলেজের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

পরিণতি ও নতুন সিদ্ধান্তের দাবি

এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পরে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে মুখর। তারা চাইছে:

একটি স্বচ্ছ, স্বাধীন তদন্ত কমিটি

প্রতিরক্ষা খাতের আধুনিকীকরণ ও খোলামেলা নীতি

F‑7 বহরের সম্পূর্ণ বাতিল

নিহতদের পরিবারের জন্য আর্থিক ও মানসিক পুনর্বাসন উদ্যোগ

এই দুর্ঘটনা কোনো "অ্যাক্সিডেন্ট" নয়। এটি ছিল দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক গাফিলতির একটি সরাসরি ফলাফল, যার মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জীবন দিয়ে।

নিরাপত্তা সংস্কৃতির অভাব

বাংলাদেশে বিমান নিরাপত্তার বিষয়ে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব গভীর। ফ্লাইট লগ, মেরামত ইতিহাস, নিরাপত্তা অডিট রিপোর্ট সাধারণের কাছে গোপন রাখা হয়। ফলে দুর্ঘটনার পেছনের বাস্তব কারণ জানতেও অসুবিধা হয়।

সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা একযোগে মনে করেন,

“নিরাপত্তা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব, কিন্তু তা না হলে ঝুঁকি চিরস্থায়ী।।”

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও জনক্ষোভ

মিলস্টোন দুর্ঘটনার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষ তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। অনেকেই বলেছেন:

“আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপত্তা চাই, দেরি নয়।”

“দুস্থ ও দুর্বলদের প্রতি সরকার কি দায়িত্বশীল?”

“দুর্নীতি বন্ধ না হলে একই ভুল বারবার হবে।”

একজন মা লিখেছেন,

“আমি আমার সন্তানের জন্য নিরাপত্তা চাই, কিন্তু সরকার দুর্নীতি আর অবহেলার কারণে নিরাপত্তার মান নিয়ে খেলা করছে।”

কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া ও পরিকল্পনা

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনার পর বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—নতুন বিমান কেনার প্রক্রিয়া শুরু, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, এবং তদন্ত প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার উদ্যোগ। তবে বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট সময় ও রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন।

উপসংহার: পরিবর্তন না এলে পুনরাবৃত্তি অনিবার্য

বাংলাদেশের বিমান নিরাপত্তায় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ না হলে পরবর্তী দুর্ঘটনা অনিবার্য। প্রয়োজন রাজনৈতিক সচেতনতা, অর্থ বরাদ্দের স্বচ্ছতা এবং প্রশাসনিক সংস্কার। নিরাপত্তার জন্য যেকোনো রকমের ত্রুটি বা অবহেলা থেকে অবশ্যই বাঁচতে হবে, নয়তো আরও প্রাণহানি ঘটবে।


Comments

Popular posts from this blog

বাংলাদেশে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণের নতুন অধ্যায় – জাতিসংঘ অফিসের প্রস্তাব কী নির্দেশ করে।

পিআর চালুর বাস্তব রোডম্যাপ: বাংলাদেশে পরবর্তী ৫ বছরে কীভাবে শুরু করা সম্ভব?”

জুলাই ঘোষণাপত্র: একটি জাতির সংকল্প ও বৈশ্বিক অনুরণন